রপ্তানি ও বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধি সত্ত্বেও ঐতিহাসিক উচ্চতায় বাণিজ্য ঘাটতি

বৈদেশিক সহায়তা ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি সাধারণ সময়ে একটি উদ্দীপক শক্তি হলেও, তা বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি ঘিরে তৈরি উদ্বেগ তেমন একটা দূর করতে পারেনি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে ২৭.৫৬ ডলারের ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে এই ঘাটতি।
একইসময়ে ডলার বাজারের অস্থিতিশীলতা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রপ্তানির প্রবৃদ্ধি সাময়িক হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এরমধ্যেই শুরু হয়েছে চালান বাতিল আর বিলম্বের ঘটনা।
এই বাস্তবতায়, বৃহস্পতিবার (২ জুন) ডলারের নির্দিষ্ট দর বেঁধে দেওয়ার আগের সিদ্ধান্ত থেকে সম্পূর্ণ সরে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে বাজার চাহিদা অনুসারে ব্যাংকগুলি দর নির্ধারণ করতে পারবে।
ভাসমান এ বিনিময় হার আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যেমে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ উৎসাহিত করার পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মে মাসে রপ্তানিতে ২৩% প্রবৃদ্ধি হয়েছে, যা চলতি অর্থবছরে এপর্যন্ত ৪৭ বিলিয়ন ডলার দেশে এনেছে। বৈদেশিক সহায়তার প্রবাহও এপ্রিল পর্যন্ত বার্ষিক ৫৯ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৭৭০ কোটি ডলার।
বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানি আয়ের তুলনায় যখন বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, তখনই এসব ইতিবাচক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
মে মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহও ১৩ শতাংশ কমে গিয়ে দেশের ৪২.১১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিরাপদ সীমায় থাকবে কিনা এমন উদ্বেগ জোরালো করে তুলেছে।
বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি– দেশের রপ্তানি আয়ের সাথে আমদানি খরচের ব্যবধান– গত অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল মেয়াদের চেয়ে ৫৩ শতাংশ বেশি হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার (২ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে।
ফলে এই অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে দেশের চলতি হিসাবের ঘাটতি এক বছর আগের তুলনায় ৯ গুণের বেশি বেড়ে ১৫.৩১ বিলিয়ন ডলার হয়। তবে এ সময়ে নেট সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ ও পুঁজি স্থানান্তরে সন্তোষজনক প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক তথ্য।
রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক অর্থায়নের এসব উপাত্ত এখন দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্ট (বিওপি) পরিস্থিতিতে স্বস্তি ফিরিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বৈদেশিক সহায়তা বৃদ্ধিও স্বস্তির কারণ:
বাজেট সহায়তাসহ চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড়ও বেড়েছে ৫৯ শতাংশ। তাতে ক্রমহ্রাসমান মুদ্রারিজার্ভে স্বস্তি ফিরেছে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে ৭৭০ কোটি ডলার অর্থছাড় করে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো।
চলতি অর্থবছরে বাজেট সহায়তা এবং টিকা কেনা বাবদ অর্থছাড় হয়েছে ১৮৫ কোটি ডলার। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এআইআইবি, জাইকা, কোরিয়া এবং ওপেক ফান্ড- এর কাছ থেকে এ অর্থ পাওয়া গেছে।
এর মধ্যে টিকা কেনার ছাড় হয়েছে ৯৫৬ মিলিয়ন ডলার। আর বাজেট সহায়তার অর্থ ছাড় হয়েছে ৮৯৫ মিলিয়ন ডলার।
এছাড়া চলতি মাসে বিশ্বব্যাংকের ২৫০ মিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তার অর্থ ছাড় হবে। গত ১৮ এপ্রিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের এই ঋণ চুক্তি হয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাজেট সহায়তার অর্থ চুক্তি হওয়ার পর পরই ছাড় হয়ে যায়। এটা সরাসরি রিজার্ভে জমা হয়। ফলে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে বাজেট সহায়তার অর্থ কিছুটা স্বস্তি হিসেবে কাজ করছে। অন্যদিকে টিকা কেনার অর্থ রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ভূমিকা রাখছে। কারণ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে সহায়তা না পেলে রিজার্ভের অর্থেই তা কিনতে হতো।
গত অর্থবছরে বাজেট সহায়তা এসেছিল ১.০৯ বিলিয়ন ডলার। এর আগে কোভিড পরিস্থিতি মোকাবেলায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১ বিলিয়ন ডলার বাজেট সহায়তা পেয়েছে। তার আগপর্যন্ত বাংলাদেশের যেকোনো অর্থবছরে বাজেট সহায়তার পরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন ডলারের কম ছিল।
এদিকে ইআরডির কর্মকর্তারা জানান, আগামী অর্থবছরে সরকার বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে বাজেট সহায়তা পাবে বলে আশা করছে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং এআইআইবি কাছ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলার করে সহায়তা প্রত্যাশা করছে। এছাড়া, জাইকার কাছ থেকে বড় অংকের বাজেট সহায়তা পাওয়ার আশা করছে সরকার।
ইআরডির কর্মকর্তারা আরও জানান, গত অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল সময়ে বৈদেশিক সহায়তার অর্থছাড় ছিল ৪৮৫ কোটি ডলার। তবে অর্থবছর শেষে তা বেড়ে ৮৯৫ কোটি ডলার হয়।
চলতি অর্থবছরের দুই মাস বাকি থাকতেই প্রায় সমপরিমাণ অর্থছাড় হওয়ায় ইআরডি আশা করছে, অর্থবছর শেষে বৈদেশিক অর্থছাড় ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে, যা স্বাধীনতার পর সর্বোচ্চ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে সবচেয়ে বেশি অর্থ ছাড় করেছে এডিবি। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাটির কাছ থেকে পাওয়া গেছে ১৯৮ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৭০ কোটি ডলার অর্থছাড় করেছে জাইকা।
এদিকে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের শেষে দিকে এসে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ থেকে অর্থ ব্যয়ে কিছুটা গতি বেড়েছে।
এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে এডিপিতে বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দে ৩২.৩৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল ৩০ শতাংশ। যদিও বৈশ্বিক সংকটময় পরিস্থিতির কারণে কিছু প্রকল্পের গতি কমছে।
অর্থবছরের জুলাই –এপ্রিল সময়ে অর্থছাড় বাড়ার পাশাপাশি সরকারের ঋণ পরিশোধের হারও বেড়েছে। এসময়ে সরকার উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোকে ঋণের সুদ ও আসল বাবদ ১৭৫ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে। গত অর্থবছরে একই সময়ে সরকার পরিশোধ করেছিল ১৬০ কোটি ডলার।
রপ্তানিতে ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি
ঈদের কারণে এক সপ্তাহেরও বেশি সময় কারখানায় উৎপাদন বন্ধ থাকার পরও চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মে মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ে ২৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে অর্থবছরের জন্য সরকার নির্ধারিত ৫০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আরেকধাপ অগ্রগতি হয়েছে।
চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে বাংলাদেশ রেকর্ড পরিমাণ ৪৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় করেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান এ এইচ এম আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এ গতি ধরে রাখা গেলে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় অনায়সে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করবে।
অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতি এবং এর জেরে বাংলাদেশর প্রধান রপ্তানি বাজারগুলোতে মূল্যস্ফীতির কারণে ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় আগামী মাসগুলোতে রপ্তানির গতি ধরে রাখা নিয়ে কিছুটা সংশয়ও দেখা দিয়েছে।
এর মধ্যেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে সুদ হার বাড়িয়ে দিয়েছে, এতে এসব বাজারের ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।
কমতে পারে পোশাক রপ্তানি
বিশ্বের প্রথম এলইইডি-প্ল্যাটিনাম প্রত্যয়িত ডেনিম টেক্সটাইল- এনভয় টেক্সটাইল লিমিটেডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বিদেশে দোকানগুলোয় বিক্রি কমে যাচ্ছে, একারণে আগামীদিনে পোশাক রপ্তানির কিছু অর্ডার বাতিল এবং শিপমেন্ট বিলম্বিত হতে পারে।
"বিশ্ব অর্থনীতি মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের সময় আমাদের রপ্তানি বাজার থেকে আসা অর্ডারের চাপ ছিল। তখন প্রায় প্রতিটি দোকানই খালি ছিল। কিন্তু, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সবকিছু বদলে দিয়েছে।"
তিনি বলেন, ইউরোপিয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তারা ব্যয় কমাবে, যা পোশাকের চাহিদাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আরও জানান, বিলম্বিত চালান তো আছেই- তার ওপর ইতোমধ্যেই একজন বায়ার ২.৫ শতাংশ মূল্যছাড় চেয়েছেন। যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইপিবির বিশ্লেষণে মে মাসে সবচেয়ে কম রপ্তানি আয়ের চিত্র
বৃহস্পতিবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মে মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় হয়েছে ৩৮৩ কোটি ডলার।
অবশ্য ইপিবি'র পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত ১১ মাসের মধ্যে গত মাস ছিল দ্বিতীয় সর্বনিম্ন রপ্তানি আয়ের মাস। এর আগে গত আগস্টে মে মাসের চেয়েও কিছুটা কম রপ্তানি হয়েছিল। আর গত সেপ্টেম্বর থেকে টানা আট মাস রপ্তানি আয় ৪ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল।
গত মে'তে তা না হলেও রপ্তানি আয়, গত বছরের মে মাসের ৩১০ কোটি ডলারের তুলনায় বেশি হয়েছে। যদিও সেটা ওই মাসের জন্য নির্ধারিত ৩৮৯ কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি।
বিশ্বের অন্যতম পরিবেশসম্মত নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক প্লামি ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক এবিষয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ঈদের ছুটির কারণে মে'তে পোশাকের চালান পাঠানো কিছুটা ধীর গতিতে হয়, ফলে ব্যবসা করার জন্য পুরো মাস সময় পাওয়া যায়নি।"
তবে তিনি এও উল্লেখ করেন যে, গত বছরের তুলনায় এবার রপ্তানির পরিমাণ ভালো হয়েছে। তবে অর্ডার প্লেসমেন্ট মন্থর হওয়ায় আগামী মাসগুলোতে রপ্তানি কমার আশঙ্কাও করছেন।
ইপিবির তথ্যে আরও দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ের মধ্যে রপ্তানি আয় বছরওয়ারি হিসাবে ৩৪.০৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে।
এপ্রিলে দেশের রপ্তানি আয় হয় ৪ বিলিয়ন ডলার। ওই মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫১ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়। সে সুবাদে চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে রপ্তানি আয় হয় ৪৩.৩৪ বিলিয়ন ডলার।