ভাড়ার যুদ্ধে কারা জিতছে: অ্যাপ না-কি খ্যাপ?

শাহবাগ মোড়ে তখন পড়ন্ত রোদ্দুর আবছা হয়ে আসছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে। মো. সাইদুর শেষ ভাড়াটা মেরে বাইকটা সাইডে থামিয়ে একটু জিরোচ্ছেন। এই সময়টায় চাপ কিছুটা কম থাকে। তবে সন্ধ্যা নামলেই আবার শুরু হবে ব্যস্ততা।
অফিস শেষে মধ্যবয়সী মানুষজন তখন বাসার পথ ধরেন। কেউ হয়তো মেয়ের জন্মদিনের জন্য তাড়ায়, কেউ বা অন্য কোনো জরুরি কাজে।
ঢাকায় সন্ধ্যা নামলেই কোলাহল বেড়ে যায়। গাড়িগুলো যেন রাস্তায় রেসে নামে। সত্যিকারের রেস নয় ঠিকই, তবে কোনো উঁচু ভবন থেকে তাকালে মনে হয় যেন বিশেষ কোনো দাবিতে গাড়ির সম্মেলন চলছে। ওপর থেকে সিগন্যালের আলো আর গাড়ির সারি দেখতে খারাপ লাগে না, বরং চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু মুশকিলটা হয় গাড়ির মধ্যে বসে থাকা মানুষগুলোর। সমস্ত দিনের ক্লান্তি বুকে নিয়ে তারা গাড়িতে বসে থাকেন অবসন্ন হয়ে, শরীর যেন আর চলে না। রোজকার এই জ্যামের যন্ত্রণায় ক্ষণিকের স্বস্তির আশায় অনেকেই চেষ্টা করেন একটু দ্রুত বাড়ি ফিরতে।
আর এই সামান্য স্বস্তির ইচ্ছেটাকে বাস্তব করে তোলেন মো. সাইদুরের মতো বাইক রাইডাররা। ঢাকাবাসীর কাছে রাইডার এখন পরিচিত এক নাম। রাইডার খুঁজতে নানা অ্যাপও দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
তবে অ্যাপের বাইরেও আছে চুক্তিভিত্তিক রাইডিং। সেখানে কোনো মধ্যস্থতাকারী লাগে না—রাইডার আর যাত্রীর সরাসরি দরাদরিতেই ঠিক হয় ভাড়া।
কিন্তু অ্যাপের এত জনপ্রিয়তা কি চুক্তিভিত্তিক রাইডারদের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে? সে তো খোদ রাইডার আর কাস্টমাররাই বলতে পারবেন। তাই তাদের সাথে কথা জমলো অ্যাপ বনাম খ্যাপ নিয়ে।
রাইডাররা প্রাধান্য দেন খ্যাপকে
আড়াই বছর ধরে বাইক রাইডার হিসেবে কাজ করছেন মো. সাইদুর। কখনো খ্যাপে, কখনোবা অ্যাপে যাত্রী তুলছেন তিনি। সাইদুরের ভাষায়, অ্যাপে কাস্টমার নিতে হয় নিতান্ত প্রয়োজনে, কিন্তু খ্যাপ চালানো যেন একধরনের বিলাসিতা।
উবার, পাঠাও, ইনড্রাইভের মতো অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই কাস্টমার পাওয়া যায়। তাই অনেক বাইক রাইডার এসব অ্যাপের ওপর নির্ভরশীল। তবু খ্যাপ চালানো অনেক বেশি লাভজনক বলেই মনে করেন সাইদুর।
কারণ, ভাড়ায় চলা যাত্রীদের বেশিরভাগই ভাড়ার সঠিক হিসাব জানেন না। এতে ইচ্ছেমতো দাম হাঁকানো যায়। আবার কোনো কাস্টমার যদি আচরণে কৃপণ মনে হয়, তখন ভাড়া একটু বেশি চেয়ে দরাদরিরও সুযোগ থাকে। দর কষাকষিতে ভাড়া কিছুটা কমলেও, রাইডারের তেমন লস না।

তবে এমন কাস্টমারও আছেন, যারা ভাড়ার হিসাব ভালোভাবেই জানেন। তবু খ্যাপের সুবিধা হলো—যদি যাত্রী সন্তুষ্ট হন, তাহলে বাড়তি ভাড়া পাওয়ারও একটা সম্ভাবনা থাকে।
রাইডার সাইদুর চাকরি চেষ্টা যে একেবারেই করেননি, তেমনটা নয়। কিন্তু ভাগ্যের শিকে সহজে ছিড়তে চায় না। যদিও বা চাকরির সন্ধান মিলেছে, কিন্তু সকলেই চায় ৮-১০ বছরের অভিজ্ঞতা। তারপর বেতনও শুরুতে অত ভালো না।
সবদিক বিবেচনায়, নিজের শখের বাইকটাকেই রুটিরুজির মাধ্যম করেছেন তিনি। এখন এই বাইকই তার সোনার হরিণ।
অ্যাপের মধ্যে সাইদুরের সবচেয়ে পছন্দ হলো পাঠাও। পাঠাওয়ের মাধ্যমে ভাড়া নিলে ট্রিপপ্রতি ১৫ শতাংশ কমিশন কোম্পানিকে দিতে হয়। তবে নানা ধরণের বোনাসও থাকে। আর নির্দিষ্ট সময়ে (৩-৪ ঘণ্টায়) ছয়টি ট্রিপ শেষ করতে পারলে কমিশন কমে ১০ শতাংশে নেমে আসে।
পাঠাওয়ের আরেকটি সুবিধা হলো—ডিজিটাল ক্রেডিট ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে টাকা সঙ্গে সঙ্গে একাউন্টে জমা পড়ে। এছাড়া সাধারণত কাস্টমার কল আসে ৫০০ থেকে ৬০০ মিটারের মধ্যে। ফলে দূর থেকে এসে যাত্রী তুলতে অতিরিক্ত তেল খরচের ঝামেলা নেই।
সম্প্রতি পাঠাও পার্সেল সার্ভিস চালু করেছে। এতে অল্প সময়ে বেশি আয় করার সুযোগ তৈরি হয়েছে বলেও জানালেন সাইদুর।
পাঠাওয়ের পর সাইদুরের দ্বিতীয় পছন্দ ইনড্রাইভ। কারণ এখানে রাইডারদের থেকে আলাদা করে কোনো কমিশন কাটা হয় না। পুরো ভাড়াটা নিজের পকেটে ঢুকলে খুশি হবেন না এমন কে আছে!
ইনড্রাইভে ফোনও আসে প্রচুর। তবে এর কিছু ঝামেলাও আছে। অনেক সময় কভারেজ এরিয়ার বাইরে থেকে কল আসে, তখন রাইডারদের নাজেহাল হতে হয়।
সাইদুরের মতে, রাইডারদের কাছে এখন সবচেয়ে পিছিয়ে আছে উবার। প্রতিদিন ৭০ টাকা কমিশন দিতে হয়, অথচ কাস্টমার মেলার নিশ্চয়তা নেই।
তবে অ্যাপের গল্প যতই চলুক, খ্যাপের কথা উঠতেই সাইদুরের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তিনি রাইডারদের এক চালাকির গল্পও শোনালেন।
অ্যাপে রাইড ডাকলে যাত্রীকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে উঠে পড়তে হয়। যাত্রী দেরি করলে রাইড ক্যানসেল হয়ে যায়। কিন্তু রাইডার হয়তো তখনও আরেকটি ভাড়া খুঁজে পাননি, ওই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছেন। যে যাত্রীর ট্রিপ সময়সীমার কারণে ক্যানসেল হয়ে গেছে রাইডার তাকেই খ্যাপে নিয়ে আসবার প্রস্তাব দেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যাত্রী রাজি হয়ে যায়। রাইডার কিছুটা লাভের মুখ দেখেন।

শুধু সাইদুর নয়, আরেকজন রাইডার, শফিকুর রহমানও অ্যাপ বনাম খ্যাপের প্রশ্নে খ্যাপের দিকেই ঝুঁকলেন।
শফিকুর মনে করেন, খ্যাপেই রাইডারদের লাভ বেশি। তবে সময় বুঝে চলতে হয়। যখন অ্যাপে ভাড়া বেশি, তখন অ্যাপ না চালালে আয় কমে যায়।
তার ভাষায়, "সুদের চেয়ে আসল ভালো।" খ্যাপে যাত্রী মেলে কম, তাই বসে না থেকে অ্যাপে ভাড়া ধরতে হয়। দিনে দিনে অন্তত হাজার দুই এক টাকা আয় হয়ে যায়।
বিশেষ করে বৃহস্পতি ও শুক্রবারে অ্যাপে বেশি ফায়দা পাওয়া যায়।
তবে শফিকুরও স্বীকার করলেন, খ্যাপে রাইডার যেমন লাভবান হন, যাত্রী ততটা হন না। সময়ের তাড়ায় অনেকে খ্যাপের যাত্রী হন, তখন দামাদামির সুযোগও থাকে না। অ্যাপে সবসময় রাইডার মেলে না, আর তাড়ার সময়ে যাত্রীও নিরুপায় হয়ে রাজি হয়ে যান।
কেউ অ্যাপ, কেউ বা খ্যাপ
অর্ণব চৌধুরী, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। পরীক্ষার সময় জ্যাম এড়াতে তিনি রাইড শেয়ারিংয়ে ভরসা রাখেন। অ্যাপ আর খ্যাপের মধ্যে বেছে নিয়েছেন খ্যাপকেই।
মাঝেমধ্যে অবশ্য অ্যাপও ব্যবহার করেন, তবে সাশ্রয়ের দিক দিয়ে খ্যাপই তার প্রথম পছন্দ।
অর্ণবের কৌশলটা মজার। তিনি আগে অ্যাপে ভাড়া দেখে নেন, তারপর সেই অনুযায়ী খ্যাপে দর হাঁকেন।
যেমন—অ্যাপে যখন ভাড়া দেখায় ১১০ টাকা, তখন তিনি খ্যাপে ভাড়া বলেন ৯০ টাকা। রাইডার দর হাঁকায় ১৫০ টাকা। শেষমেশ ১১০ টাকাতেই দুজনের বোঝাপড়া হয়। কখনো ১০০ টাকাতেও ভাড়া মিলে যায়। ফলে, অ্যাপে রাইডারের জন্য অপেক্ষার সময়টুকুও বেঁচে যায়। এমনটাই জানালেন অর্ণব।
তাসফিয়া প্রমি অবশ্য বললেন ভিন্ন কথা। অফিস যাওয়ার সময় তিনি উবার সিএনজি ব্যবহার করেন।
তার মতে, বাইক খ্যাপে কিছুটা সাশ্রয় হলেও সিএনজির ক্ষেত্রে খ্যাপের ভাড়া বেশি পড়ে। আর বাইক খ্যাপে তুলনামূলক ভাড়া কম হলেও নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকেই যায়।
অ্যাপে সেফটি এলার্ট, কন্ট্যাক্ট অ্যাডের মতো ফিচার থাকায় নিরাপত্তা বেশি। চাইলে রাইডারকে রিভিউ আর রেটিংও দেওয়া যায়।

তাসফিয়ার ভাষায়, "ভাড়া একটু কমবেশি হলেও নিরাপত্তার জন্য আমি অ্যাপকেই বেছে নিই।"
আরেক নারী যাত্রী, ফারজু, বললেন অন্য অভিজ্ঞতার কথা।
তিনি মনে করেন, খ্যাপে চালককে সামনাসামনি দেখা যায়, দরদাম করা যায়, যা অ্যাপে সম্ভব নয়।
তার ওপর খ্যাপে ভাড়ার ওঠানামার ঝামেলা নেই। অ্যাপের নানা অপশন ঘাটাঘাটির বাড়তি ঝামেলা না থাকায় খ্যাপই তার কাছে বেশি আরামদায়ক।
অ্যাপ আর খ্যাপের বিতর্কে কিছুটা মুশকিলে পড়লাম দুই পক্ষের যাত্রীদের একেবারে বিপরীত মতামত দেখে। একপক্ষ যখন খ্যাপের পক্ষে রায় দিয়ে বসে, অন্যপক্ষ তা একেবারেই মানতে নারাজ।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এআইইউবির ছাত্রী অনিন্দিতা জানালেন অ্যাপের সুবিধার কথা। তার মতে, অ্যাপে নিজের পছন্দমতো রাইড খোঁজা যায়। চাইলে বাইকের বদলে কার কিংবা সিএনজিও বেছে নেওয়া যায়। তাছাড়া নিয়মিত যাত্রীদের জন্য নানা রকম ডিসকাউন্টও থাকে।
দামের ব্যাপারেও ঠকবার আশঙ্কা কম। অনিন্দিতা জানালেন, যতবার খ্যাপে যাতায়াত করেছেন, প্রতিবারই ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি ভাড়া দিতে হয়েছে।
ইসিবি চত্বর থেকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় পাঠাও ব্যবহার করে নিয়মিত যাতায়াত করা মাহির লাবিবও শোনালেন এমনই অভিজ্ঞতার কথা।
তিনি বললেন, "খ্যাপে গেলে রাইডাররা প্রায়ই জ্যামের অজুহাত দিয়ে বেশি ভাড়া চান। আবার মাঝেমধ্যে ইচ্ছেমতো ঘুরিয়ে নিয়ে সময় ও ভাড়া দুটোই বাড়ান। যারা অ্যাপে রাইড ডাকতে ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে চান না, তারা শেষমেশ খ্যাপে সময়ের সাথে সাথে পকেটের টাকাও জলাঞ্জলি দেন। বোকার স্বর্গে বাস করলে যা হয়।"
অন্যদিকে, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার সিএনজি চালক সেলিম আহম্মদ জানালেন ভিন্ন বাস্তবতার কথা।
সেলিমের মতে, সিএনজির ক্ষেত্রে অ্যাপ সাইড ইনকামের জন্য ভালো হতে পারে। কিন্তু পুরো সময়ের জন্য নয়। কেননা, তিনি নিজে সিএনজির মালিক নন।
বেশিরভাগ সিএনজি চালকই মহাজনের গাড়ি চালান। গাড়ি বের করলেই মহাজনকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা জমা দিতে হয়। এই টাকাটা তুলতে হলে খ্যাপ চালানো ছাড়া উপায় থাকে না। তবে যখন যাত্রী কম থাকে, তখন অ্যাপে দুই-একটা ভাড়া নিয়ে সময়টা কাজে লাগান।
অ্যাপ বনাম খ্যাপের তর্কে যুক্ত হলেন প্রবীণ সিএনজি চালক মান্নানও। তিনি ৩০ বছর ধরে সিএনজি চালাচ্ছেন।

মোবাইল প্রযুক্তিতে খুব একটা দক্ষ নন, তবে তার এন্ড্রয়েড ফোনে অবসরে খবর শোনেন। মান্নান জানান, খ্যাপে সিএনজি চালিয়ে তেমন লোকসান হয় না। বরং অনেক সময় আবদার করলে যাত্রীরা দু-চার টাকা বাড়তি ভাড়া দিয়ে দেন।
তার ভাষায়, "এত কারিগরি করে অ্যাপ খুলে ঝামেলায় যাই কেন? সারাজীবন যেভাবে চলেছি, সেভাবেই ভালো আছি।"
তার মতে, সামান্য যাতায়াতের জন্য অনেক যাত্রীও এত ঝক্কি পোহাতে চান না।
সুতরাং, খ্যাপ বনাম অ্যাপের এই বিতর্ক চলতেই থাকবে। তবে দুই পক্ষকে এক জায়গায় আনা যায় তখনই, যখন জিজ্ঞেস করা হয়—কেন অ্যাপ বা খ্যাপের মাধ্যমে যাতায়াত করেন?
উত্তর তাদের একটাই: 'দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে চাই'।