মোট ব্যয়ের মাত্র ২ শতাংশ গবেষণায় খরচ করছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো
২০২০ সালে দেশের ১৪২টি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মোট ১৮৪ কোটি টাকা ব্যয় করেছে গবেষণায়। গড় হিসাবে প্রত্যেকে করেছে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা তাদের মোট একাডেমিক ব্যয়ের মাত্র ২ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) জানিয়েছে এসব তথ্য।
গবেষণা খাতে অপ্রতুল ব্যয়কে-ই বৈশ্বিক জ্ঞান সূচক-২০২১ (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স) এর সারণীতে ১৫৪ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ১২০তম স্থানে থাকার কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
একটি দেশের জ্ঞান চর্চার সক্ষমতা নিরূপণে সারণীতে ছিল মোট সাতটি খাত, যার মধ্যে গবেষণা, উন্নয়ন আর উদ্ভাবনেই সবচেয়ে খারাপ পারফর্ম করেছে বাংলাদেশ।
গবেষণা, উন্নয়ন আর উদ্ভাবন খাতে মোট ১০০ স্কোরের ভেতর বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ১৯.২। গত বছরও এই খাতে এই খাতে সবচেয়ে কম স্কোর ছিল এদেশের।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর মন্তব্য করেন যে, সারণীটিতে আমাদের গবেষণা ও উন্নয়ন খাতের প্রকৃত দুরাবস্থার চিত্রই প্রতিফলিত হয়ছে। এর প্রধান কারণ হিসেবে বিশ্বের শীর্ষ ৫০০টির মধ্যেও বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের না থাকার ঘটনাকে উল্লেখ করেন তিনি।
ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, উদ্ভাবন নিয়ে তাগিদ না থাকায় বাংলাদেশের বেশিরভাগ শিল্পও 'কপি-পেস্ট' শিল্পরূপে গড়ে উঠেছে।

কে কত টাকা ব্যয় করছে
ইউজিসি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে ৩৮টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ব্যয় ছিল মাত্র ৭৩ কোটি বা গড়ে ১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। অন্যদিকে, ৭৭ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করেছে ১১১ কোটি বা গড়ে ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা।
ওই বছর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ মোট ব্যয় করেছে ৫ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকা। বেসরকারিতে যা ছিল ৩ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গড়ে তাদের মোট বাজেটের ১.৫৮ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করে, বেসরকারিতে এই অনুপাত ছিল ১.১৫ শতাংশ।
ইউজিসির সাম্প্রতিক প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ব্যয়ের দিক থেকে শীর্ষ ১০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ২০২০ সালে গবেষণায় বিনিয়োগ করে ১০১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালের চেয়ে এই অঙ্ক ১৯ কোটি টাকা বেশি। আর শীর্ষ ১০ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখাতে ব্যয় করেছে মাত্র ৪৩ কোটি টাকা।
২০২০ সালে শুধুমাত্র ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় করেছে ৫৫ কোটি টাকা গবেষণা ব্যয়, যা শীর্ষ ১০ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা তহবিলের চেয়েও ১২ কোটি টাকা বেশি।
ওই বছর কোনো রকম গবেষণা করেনি এমন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ১৩টি। একইবছর আটটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও কোনো গবেষণা করেনি বলে জানাচ্ছে ইউজিসির তথ্য।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ব্যয় সামান্য
দেশের মোট ৫০ সরকারি ও ১০৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছাত্র সংখ্যা ৪০ লাখ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রায় সাড়ে ৩ লাখ।
২০২০ সালে গবেষণা খাতে ব্যয়ের ভিত্তিতে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাত থেকে শীর্ষ ১০ বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারণ করেছে টিবিএস।
এতে দেখা গেছে, শীর্ষ ১০ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ব্যয় শীর্ষ ১০ সরকারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ে ছিল ২৮ কোটি টাকারও বেশি।
ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, স্বনামধন্য ১০ বেসরকারি উচ্চতর বিদ্যাপীঠ গবেষণায় বিনিয়োগ করেছে ১০১ কোটি টাকা, আর শীর্ষ ১০ সরকারি প্রতিষ্ঠান করেছে ৪৩ কোটি টাকা।
২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মোট ব্যয় ছিল ৭৮৭ কোটি টাকা, যারমধ্যে মাত্র ৬.৬১ কোটি টাকা বা মোট ব্যয়ের দশমিক ৮৩ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় হয়।
ঢাবির ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গবেষণায় আরও বিনিয়োগের চেষ্টা করছে এবং শিক্ষকদের মানসম্পন্ন গবেষণা করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
দেশের আরেক শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর ২০২০ সালে মোট ব্যয় করেছে ২৫৩ কোটি টাকা, যার মাত্র ১.১২ শতাংশ বা ৩ কোটি টাকা পেয়েছে গবেষণা খাত।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সদ্য সাবেক উপাচার্য ফারজানা ইসলাম অবশ্য দাবি করেছিলেন, ২০২০ সালের গবেষণা তহবিল আগের বছরের চেয়ে কিছুটা বেড়েছিল।
২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর সার্বিক ব্যয় ২১৪ টাকা হলের এর মাত্র ১ শতাংশ বা ২ কোটি ৩০ লাখ টাকা যায় গবেষণায়।
বেসরকারিতে গবেষণায় অর্থায়ন তুলনামূলকভাবে ভালো
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালে মোট ৩৩৫ কোটি টাকা ব্যয় করেছে, এরমধ্যে ৫৫ কোটি টাকা বা মোট ব্যয়ের ১৬.৪১ শতাংশ পেয়েছে গবেষণা খাত।
ব্র্যাকের ভিসি অধ্যাপক ভিসি অধ্যাপক ভিনসেন্ট চ্যাং বলেন, "আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গুরুত্বের একটি ক্ষেত্র হলো এমন গবেষণা বৈশ্বিক কল্যাণে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচনা করতে পারে।"
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশ (এআইইউবি) ২০২০ সালে মোট ব্যয় করেছে ২৩৯ কোটি টাকা, যার ৩.৮৯ শতাংশ বা ৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা হয়েছে গবেষণায়।
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) সার্বিক ব্যয় ছিল ৬৯ কোটি টাকা, যার ৪.৩৪ শতাংশ বা ৩ কোটি টাকা গবেষণা খরচ ছিল।
ইউআইইউ এর উপাচার্য মফিজুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গবেষণার মধ্য দিয়ে জ্ঞান সৃষ্টিই তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এর মোট পরিচালন খরচ ছিল ৭০ কোটি টাকা, যার ১২ শতাংশ বা ৮ কোটি ৩৭ লাখ টাকা গবেষণায় ব্যয় হয়েছে।
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, তার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ব্যয়ে কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। এনএসইউ মানসম্পন্ন গবেষণা কর্মে বিশ্বাসী- তাই গবেষকদের চাহিদামতো অর্থ বরাদ্দ করা হয়।
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ডিআইইউ) স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক ড. সৈয়দ মিজানুর রহমান বলেন, "প্রতিদিনই আমাদের পৃথিবী দ্রুত বদলাচ্ছে। বর্তমানে গবেষণা ও উন্নয়নই আমাদের কাছে শীর্ষ গুরুত্বের। কারণ আমরা জানি, জাতির ভবিষ্যৎ শিক্ষার ভার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপরই বর্তায়।"
গবেষণা খাতে ন্যূনতম ১০ শতাংশ ব্যয়ের পক্ষে বিশেষজ্ঞরা
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এমিরেটাস মঞ্জুর আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়কে অবশ্যই মানসম্পন্ন গবেষণায় মনোনিবেশ করতে হবে এবং একে তাদের সর্বাধিক গুরুত্বের জায়গায় স্থান দিতে হবে।
তার মতে, গবেষণায় অর্থায়ন মোট একাডেমিক ব্যয়ের অন্তত ১০ শতাংশ হওয়া উচিত, নাহলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না।
শিক্ষাবিদেরা প্রতিবেশী ভারতের উদাহরণ টেনে বলেছেন, দেশটি আগামী পাঁচ বছরে গবেষণা ও উদ্ভাবনে ৫০ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ দিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, একাডেমিক বাজেটের মাত্র ২ শতাংশ গবেষণা খাতে ব্যয় অত্যন্ত কম ও অপর্যাপ্ত।
"এত কম টাকায় গবেষকদের পক্ষে মানসম্মত গবেষণা করা সম্ভব হয় না"- যোগ করেন তিনি।
ইউজিসি তাদের প্রতিবেদনে, গবেষণা বাড়াতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি, কেন্দ্রীয় গবেষণাগার ও জাতীয় গবেষণা পরিষদ প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করেছে। একইসঙ্গে, উচ্চ শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির সুপারিশও করেছে।