কেমন আছে আমাদের ‘বনের কৃষক’, উপকারী ধনেশ পাখিরা?
আগস্টের একদম শেষের দিক। পাহাড়ে যাব যাব করেও যাওয়া হয়নি এ বছর। সবকিছু সামলে সময় বের করা। উভচর প্রাণী দেখা এবং এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করাই মূল উদ্দেশ্য। রাতের সর্বশেষ বাসে টিকিট করে রওনা হই রাঙ্গামাটির দিকে। সাথে আছে সমী। অনেক ব্যস্ততার মাঝেও আমার সাথে যোগ দিয়েছে। বিভাগের বন্যপ্রাণী শাখার আরও তিনজন ছাত্র আগের দিন রাঙ্গামাটি গিয়ে কাজ শুরু করেছে। সকালে রাঙ্গামাটি পৌঁছে নাস্তা সেরে কোথায় কে কী কাজ করব, প্ল্যান করে নিলাম।
রাতে বিভিন্ন ছড়ায় নেমে সার্ভে করি। পরের দিন সকাল বেলায় বের হই কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানের বন্যপ্রাণী দেখার জন্য। সকালটা ছিল আর্দ্রতায় ভরা। একদিকে মেঘে ঢাকা আকাশ, অন্যদিকে কিছুটা রোদে জঙ্গলের পরিবেশ আরও রহস্যময় মনে হচ্ছিল।
উদ্যানের ব্যাঙছড়ার ট্রেইলে নেমে কিছুদুর হাঁটতেই বেশ কিছু প্রজাতির পাখি চোখে পড়ে। ঘন সবুজ বৃক্ষরাজির ভেতর দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলাম বন্যপাখির খোঁজে। এমন সময় হঠাৎ দৃষ্টি গেল এক অদ্ভুত সুন্দর পাখির দিকে। নাম তার পাকড়া ধনেশ।
ধনেশ পরিবারের এই পাখিটির ইংরেজি নাম Pied Hornbill, বৈজ্ঞানিক নাম Anthracoceros albirostris. বাংলাদেশের ধনেশ-জাতীয় পাখিগুলো দেখতে বেশ আকর্ষণীয়, কিন্তু সচরাচর চোখে পড়ে না। তাই দেখা পাওয়ার মুহূর্তটি ছিল অত্যন্ত রোমাঞ্চকর। দলের সবাই দ্রুত কিছু ছবি তুলতে সক্ষম হয়, যা এই স্মরণীয় মুহূর্তকে ধরে রাখল।
পাকড়া ধনেশ মাঝারি আকারের পাখি। এদের মাথা, গলা ও শরীরের অধিকাংশ অংশ কালো বর্ণের হলেও বুক ও পেট উজ্জ্বল সাদা। ডানার নিচে সাদা দাগ দেখা যায়। এদের ঠোঁট বড়, বাঁকানো এবং উপরের অংশে এক ধরনের ক্যাস্প বা ফাঁপা গঠন থাকে। পুরুষ ও স্ত্রী উভয়ের দেহে পার্থক্য থাকলেও সাধারণত পুরুষদের ঠোঁট অপেক্ষাকৃত বড় ও উজ্জ্বল রঙের হয়। এদের চোখের চারপাশ ফ্যাকাশে সাদা ও অনাবৃত, যা সহজে চেনার মতো বৈশিষ্ট্য।
পাকড়া ধনেশ মূলত উপক্রান্তীয় ও ক্রান্তীয় বনাঞ্চলে বাস করে। বাংলাদেশের সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘন বন, বিশেষ করে রাঙামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় এদের দেখা মেলে। এছাড়া ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশে এদের বিস্তৃতি রয়েছে। সাধারণত উঁচু গাছপালায় ঘেরা অরণ্যে এরা বসবাস করে, যেখানে পর্যাপ্ত বড় গাছ ডিম পাড়ার জন্য নিরাপদ কোটর ব্যবহার করে।
এর খাদ্য তালিকায় প্রধানত আছে বিভিন্ন গাছের ফল ও বীজ। এরা বনের বীজ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই পাখি বিভিন্ন ফল খেয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয় দূর-দূরান্তে, ফলে বন পুনর্জন্ম লাভ করে। এ কারণে এদের উপস্থিতি একটি সুস্থ অরণ্যের নিদর্শন। ধনেশ পাখিকে তাই 'বনের কৃষক' বা 'ফার্মার অভ দ্য ফরেস্ট' বলা হয়। তবে অনেক সময়ই এরা ছোট প্রাণী, কীটপতঙ্গ, টিকটিকি, গিরগিটি কিংবা ছোট সাপ খেতে পারে।
ধনেশ পাখিদের প্রজনন অত্যন্ত ব্যতিক্রমী। স্ত্রী পাখি গাছের ফাঁপা গহ্বরে ঢুকে বাইরে থেকে কাদামাটি, মল ও ফলের আঁশ দিয়ে প্রবেশপথ প্রায় বন্ধ করে ফেলে। কেবলমাত্র একটি সরু ফাঁক রাখা হয়, যেখান দিয়ে পুরুষ পাখি স্ত্রী ও বাচ্চাদের খাবার জোগায়। স্ত্রী ধনেশ ও ছানারা নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত গহ্বরেই অবস্থান করে। এই অনন্য আচরণ প্রকৃতির এক বিস্ময়কর ব্যাপার।
পৃথিবীর ৬২ প্রজাতির ধনেশ পাখির মধ্যে ৩২ টি এশিয়াতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে পাকড়া ধনেশ ছাড়াও আরও দুই প্রজাতির ধনেশ পাখির দেখা মেলে—রাজ ধনেশ ও পাতাঠুঁটি ধনেশ। রাজ ধনেশের ইংরেজি নাম Great Hornbill এবং বৈজ্ঞানিক নাম Buceros bicornis। পাতাঠুঁটি ধনেশের ইংরেজি নাম Wreathed Hornbill এবং বৈজ্ঞানিক নাম Rhyticeros undulatus। প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএন বাংলাদেশ ২০১৫-এর তালিকা অনুযায়ী, পাকড়া ধনেশ বর্তমানে ঝুঁকিমুক্ত প্রজাতি হিসেবে চিহ্নিত। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। এছাড়াও রাজ ধনেশ সংকটাপন্ন প্রজাতি এবং পাতাঠুঁটি ধনেশ অপ্রতুল তথ্যের ক্যাটাগরিতে আছে।
ঠোঁট, পালক ও মাংসের জন্য ধনেশের প্রায়ই শিকারের কবলে পড়ে। বন উজাড়, গাছপালা নিধন, প্রজননের জন্য উপযুক্ত গাছের অভাব এবং মানুষের অযাচিত শখের জন্য ধনেশ পাখির সংখ্যা দিনে দিনে কমে যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক বনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই পাখিকে বাঁচানোর জন্য দরকার জরুরি পদক্ষেপ। ধনেশ পাখি বড় গাছের ফাঁপা অংশে বাসা বানায়, তাই পুরনো ও বড় গাছ রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। বনের গাছ কাটার উপর নিয়ন্ত্রণ এবং টেকসই বন ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। যেখানে বন ধ্বংস হয়েছে, সেখানে স্থানীয় প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করে ধীরে ধীরে উপযুক্ত আবাস পুনর্গঠন করতে হবে।
বড় গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় ধনেশের প্রজনন ব্যাহত হয়। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশের গবেষণা অনুযায়ী বড় কাঠের বা ফাইবারের কৃত্রিম বাসা স্থাপন করে ধনেশকে প্রজননে সহায়তা করা যায়। ধনেশ পাখির প্রজনন সাইট শনাক্ত করে সেগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রজনন ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত।
স্থানীয়ভাবে ধনেশের ঠোঁট, পালক বা মাংসের জন্য শিকার বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে কমিউনিটি-ভিত্তিক মনিটরিং সেল গঠন করা যেতে পারে। এজন্য বন বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও স্থানীয় এনজিওগুলোর যৌথভাবে উদ্যোগ নেয়া উচিত।
কাপ্তাইয়ের মতো বনে ধনেশের মতো সুন্দর পাখি টিকে থাকা আমাদের জন্য আশার আলো। ধনেশ পাখি শুধু নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং প্রাকৃতিক বন ও পরিবেশের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রজাতি সংরক্ষণ করতে পারলে কেবল একটি পাখি নয়, পুরো বনের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হবে।
- মো. ফজলে রাব্বী: শিক্ষক ও গবেষক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
