সাবেক ‘ঘৃণিত’ মেয়রকে সরানোর গোপন বৈঠক থেকে যেভাবে নিউইয়র্কের মেয়রের আসনে মামদানি
২০২৩ সালের নভেম্বর মাসের কথা। তৎকালীন নিউইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামসের শীর্ষ তহবিল সংগ্রাহকের বাড়িতে অভিযানের পরদিনই, গোপনে একটি বৈঠকের আমন্ত্রণ পাঠায় ওয়ার্কিং ফ্যামিলিস পার্টির (ডব্লিউএফপি) নতুন নেতৃত্ব। এই প্রগতিশীল ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর জোট তখন বুঝতে পেরেছিল—তাদের 'ঘৃণিত' মেয়রকে হারানোর মোক্ষম সুযোগ এসেছে, প্রয়োজন শুধু একটি কার্যকর পরিকল্পনা।
লং আইল্যান্ড সিটির এক অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের কমনরুমে অনুষ্ঠিত সেই গোপন বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শহরের কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডার, ব্রুকলিন বরো প্রেসিডেন্ট আন্তোনিও রেনোসো এবং অঙ্গরাজ্যের সিনেটর জেসিকা রামোস। তবে সেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে উপস্থিত ছিলেন জোহরান মামদানিও, যা সেসময় বাকিদের মনে প্রশ্ন তৈরি করে।
প্রথম বৈঠক থেকেই সম্ভাব্য অন্যান্য প্রার্থীরা যখন নিজেদের পরিকল্পনা গোপন রাখছিলেন, মামদানি তখন ছিলেন সবচেয়ে সক্রিয়। তিনি আইডিয়া দিচ্ছিলেন, প্রস্তাব তুলছিলেন, আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কফির আড্ডায় বারবার তিনি এমন এক প্রার্থীর প্রয়োজনীয়তার কথা বলছিলেন, যিনি ভাড়ার রেট স্থগিত করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে মাঠে নামবেন। পরে তিনি ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার প্ল্যাটফর্ম ও কর্মী কাঠামোর ভিত্তিতে নিজের প্রচারণা তৈরি করেন।
গত গ্রীষ্মে মামদানি ওই বৈঠকটির অন্যতম আয়োজক ও ডব্লিউএফপি কো-চেয়ার আনা মারিয়া আর্চিলাকে জানান যে তিনি প্রার্থী হতে যাচ্ছেন। আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ ও ব্রুকলিন সিটি কাউন্সিলম্যান চি ওসের মতো ঐতিহ্যবিরোধী রাজনীতি ভেঙে দিয়ে প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচারণা এবং 'দরজায় দরজায়' প্রচারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলেন তিনি।
আর্চিলাকে তিনি আরও বলেন, 'ওয়ার্কিং ফ্যামিলিস পার্টি কাকে প্রথমে সমর্থন জানাবে, তা ঘোষণার আগে আমাকে যতটা সম্ভব সময় দিন।'
সে সময় মামদানি তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও বন্ধু জাবারি ব্রিসপোর্টের সঙ্গে অ্যালবানি যাতায়াত করতেন। গাড়িতে তারা পালা করে মিকা ও ব্রডওয়ের জনপ্রিয় গান গাইতেন, যার মধ্যে 'হ্যামিলটন' এবং 'ডিয়ার ইভান হ্যানসেন' থেকে 'ওয়েভিং থ্রু আ উইন্ডো' তাদের প্রিয়। তবে প্রচারণা শুরু হওয়ার পর, মামদানি যাত্রাপথেই ফোনে দলের সঙ্গে কাজ করতেন, রাতে হোটেলের রুমেও সেই আলোচনা থামত না।
মঙ্গলবার রাতে, ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর, ব্রুকলিনের এক বলরুমে দাঁড়িয়ে জাতীয় টেলিভিশনের সামনে সমাজতন্ত্রী ইউজিন ডেবসের উক্তি উদ্ধৃত করে মামদানি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করলেন, তিনি নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম ও গত এক শতকে সর্বকনিষ্ঠ মেয়র।
বিজয় বক্তৃতায় মামদানি বলেন, 'সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমরা তা অর্জন করেছি।' তিনি আরও ঘোষণা দেন, ১৯৪০-এর দশকে মেয়র ফিওরেলো লা গার্ডিয়ার পর নিউইয়র্কে জীবনযাত্রার ব্যয় মোকাবিলায় সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী কর্মসূচি হবে এই যুগে। 'ভবিষ্যৎ এখন আমাদের হাতে,' বলেন তিনি।
মামদানির এই বিজয় শুধু নিউইয়র্ক নয়, বিশ্বজুড়ে এবং ডেমোক্র্যাটিক রাজনীতির ভেতরেও আলোড়ন তুলেছে। তার সমর্থকেরা সমালোচনার জবাবে বলেন, মামদানি প্রকৃত ডেমোক্র্যাট নন–এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। তাদের মতে, তার নীতিগুলো কেবল নিউইয়র্কেই নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে বৈচিত্র্যময় অঙ্গরাজ্যগুলোতেও প্রভাব ফেলতে পারে, যা পুনরায় জাতীয় ক্ষমতায় ফিরতে ডেমোক্র্যাটদের জন্য প্রয়োজন।
জনঅ্যাডভোকেট জুমানে উইলিয়ামস, যিনি গোপন বৈঠকগুলোতেও উপস্থিত ছিলেন, বলেন, 'আমার মনে হয় না, কেউই এমন ফলাফলের আশা করেছিল। তবে আমরা সবাই বলেছিলাম—আমরা আমাদের বিশ্বাসের পক্ষে দাঁড়াব।'
মঙ্গলবার সকালে এক স্কুল জিমনেসিয়ামে নিজের ভোটটি দিতে গিয়ে মামদানি ফিরে গেলেন সেই গোপন বৈঠকগুলোর স্মৃতিতে। ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিসেবে ব্যালটে নাম থাকলেও, তিনি ভোট দেন ক্রস-এন্ডোর্স করা ওয়ার্কিং ফ্যামিলিস পার্টির প্রতীকে, সিএনএনকে তাঁর এক সহকারী বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামদানির প্রচারণায় জড়িত তিন ডজন উপদেষ্টা, রাজনীতিক, প্রচারকর্মী, অনুদানদাতা ও শহর রাজনীতির অভ্যন্তরীণ সূত্রের আলোচনায় উঠে এসেছে, প্রাইমারিতে জয়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর যাত্রাপথ ছিল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি চাপের ও জটিল।
আনা মারিয়া আর্চিলা প্রাইমারির রাতের কথা স্মরণ করে বলেন, 'আমরা বুঝেছিলাম, এটাই শেষ লড়াই নয়। বিলিয়নিয়াররা ৩ কোটি ডলার শুধু হাল ছেড়ে দেওয়ার জন্য খরচ করেনি।'
প্রাইমারির পর মামদানির দলের অভ্যন্তরীণ জরিপ তাদের বিস্মিত করেছিল—ইতিবাচক বা নেতিবাচক, কোনো দিকেই ভোটারদের অবস্থান তেমন পরিবর্তন হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত তারা ভোটারদের মন জয় করার প্রচেষ্টা থেকে সরে এসে হাস্যরসাত্মক বিজ্ঞাপন ও ভিডিওর পথে যায়—'দ্য ব্যাচেলর' ও 'সারভাইভার'–এর ব্যঙ্গাত্মক রূপে তৈরি এসব ভিডিও নিজে থেকেই ছড়িয়ে পড়ে সমর্থকদের মধ্যে।
গ্রীষ্মের শেষ দিকে মামদানির প্রচারণা নিয়ে খানিকটা উদ্বেগে পড়েছিলেন আনা মারিয়া আর্চিলা ও তাঁর সহযোগীরা। তাঁদের মনে হচ্ছিল, আন্ডারডগ প্রার্থী হিসেবে যে উদ্দীপনা তাকে এত দূর টেনে এনেছিল, তা কিছুটা ম্লান হয়ে এসেছে। ধনকুবেরবিরোধী বার্তা ও 'সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, সব অনুষ্ঠানে যাওয়া' ধরনের কৌশল অব্যাহত রাখলেও, নিজের বিয়ে উপলক্ষে মামদানি কিছুদিনের বিরতি নেন। পরে ফিরে এসে ব্যবসায়ী ও নগর প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের সঙ্গে একাধিক 'ক্লোজড-ডোর' বৈঠক করেন–তাদের আশ্বস্ত করা, সম্ভব হলে মত পরিবর্তনে রাজি করানোর উদ্দেশ্যে।
এই পরিবর্তন টের পেয়েছিলেন বার্নি স্যান্ডার্সও। ভারমন্টের সিনেটর স্যান্ডার্স তার সহযোগীদের বলেছিলেন, মামদানির প্রচারণা দলের প্রস্তাব—কেবল ব্রুকলিনে এক টাউন হলে যোগ দেওয়া—তা মেনে না নিতে। স্যান্ডার্স মনে করতেন, প্রতিদ্বন্দ্বীরা যাতে তার বিপক্ষে ঐক্যবদ্ধ না হয়, সেটি ঠেকানো তখন জরুরি।
সেপ্টেম্বরের প্রথম শুক্রবার, ভোটের ঠিক আগের দিন, বার্নি স্যান্ডার্স ট্রেভর নোয়ার পডকাস্ট রেকর্ডিং স্টুডিওতে যান। সেখানে মেয়র এরিক অ্যাডামসের একটি ভিডিও দেখে স্যান্ডার্স সন্তুষ্ট হন, যেখানে অ্যাডামস সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোকে 'সাপ আর মিথ্যাবাদী' বলে আক্রমণ করেন; মামদানিকে সঙ্গে জুড়ে তাদের দুজনকে 'দুই নষ্ট বাচ্চা' বলে অভিহিত করে ঘোষণা দেন, 'আমি নিজেই ওদের হারাব।' ভিডিও দেখে স্যান্ডার্স মুষ্টি উঁচিয়ে বললেন, 'ঠিক আছে!' অ্যাডামস প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকছেন—এটাই তার কাছে ইতিবাচক খবর।
অন্যদিকে, কুমো ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকারীরা একই অনুষ্ঠান দেখছিলেন ভিন্ন আঙ্গিকে। কুমো মাসাধিককাল ধরে অ্যাডামসকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তিনি বারবার বলতেন, 'আমাকে অ্যাডামস আর স্লিওয়াকে সরাতে হবে, তাহলেই আমি জিতব। আমি জানি কাকে ফোন করতে হবে, কাকে চাপ দিতে হবে।'
তিন সপ্তাহ পর অ্যাডামস সরে দাঁড়ালে, স্যান্ডার্স ও মামদানির উপদেষ্টাদের মতে, সেটি কুমোর শিবিরের জন্য তেমন কাজে আসেনি। তবুও মঙ্গলবারের নির্বাচনে মামদানি কুয়োমোকে বড় ব্যবধানে পরাজিত করেন।
অক্টোবরের শেষ রবিবার, বার্নি স্যান্ডার্স কুইন্সের ফরেস্ট হিলস স্টেডিয়ামে চূড়ান্ত নির্বাচনী সমাবেশে অংশ নিতে নিউইয়র্কে ফেরেন। তিনি মামদানির ট্রানজিশন প্রধান এল বিসগার্ড-চার্চ ও প্রচার ব্যবস্থাপক মায়া হান্ডার কাছে বিস্তারিত পরিকল্পনা জানতে চান, বিশেষ করে প্রথম ১০০ দিনের ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, 'ওরা তোমাদের ভেঙে ফেলতে চাইবে।'
ভোটের আগের শনিবারেই মামদানি ও তাঁর সহযোগীরা টের পেয়েছিলেন—জয় তাদের হাতের নাগালেই। সেই মুহূর্তের আগেই ফোনে শোনা গেল বারাক ওবামার কণ্ঠ। গ্রীষ্মে আগের এক আলাপের কথা মনে করিয়ে মামদানি ওবামাকে ধন্যবাদ জানান, যখন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন নির্বাচনী লড়াইয়ের পাশাপাশি শাসন পরিচালনার প্রস্তুতিতেও মনোযোগ দিতে হবে।
ওবামা তাকে বলেন, 'আমি চাই তুমি একজন সফল মেয়র হও; এর মানে হলো মানুষের কাছে সেবা পৌঁছে দেওয়া, প্রশাসনের মূল কাজগুলো ঠিকভাবে করা।'
পর্দার আড়ালে, কয়েক সপ্তাহ আগেই মামদানি এক বন্ধুর কাছে অভিযোগ করেছিলেন—সবাই যেন তার ওপর চাপ দিচ্ছে, যেন এখনই তাকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরি করতে হয়। তবে তিনি তখন থেকেই তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সঙ্গে সম্ভাব্য নিয়োগের তালিকা তৈরি করছিলেন।
তবে এখনো ঝুলে আছে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—শেষ মেয়রাল বিতর্কে মামদানির আকস্মিক ঘোষণা যে তিনি বর্তমান পুলিশ কমিশনার জেসিকা টিশকে দায়িত্বে রাখতে চান। পরে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেন, টিশের সঙ্গে তিনি এ বিষয়ে সরাসরি কথা বলেননি। মামদানির দুই সম্ভাব্য উপদেষ্টাবলেন, যদি সত্যিই এমন হয়ে থাকে, তবে তা 'প্রশাসনিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার চরম উদাহরণ' হবে, ভবিষ্যৎ প্রশাসনের জন্যও এটি একটি উদ্বেগজনক ইঙ্গিত।
এদিকে, শহরের কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডার, যিনি প্রাথমিক নির্বাচনে ওয়ার্কিং ফ্যামিলিজ পার্টির প্রথম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, পরবর্তী সময়ে র্যাংকড-চয়েস ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে মামদানির মিত্রে পরিণত হয়েছিলেন, এখন আলোচনা থেকে দূরে।
গ্রীষ্মের সময় মামদানি ভেতরে ভেতরে অনুভব করতেন, ল্যান্ডার তাকে বিশেষ প্রভাবশালী মনে হচ্ছেন না। ল্যান্ডারের স্ত্রী বন্ধুদের জানান, মামদানি কম্পট্রোলারকে ফোন করে জানিয়েছিলেন তিনি প্রশাসনের কোনো পদ পাবেন না, কারণ তিনি যে পদটি চাইছিলেন তা মিলছে না। ভোটের আগের দিন, ল্যান্ডার প্রধান অনুদানদাতাদের কাছে যোগাযোগ করে কংগ্রেসের নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রতিশ্রুতি চাইছিলেন—প্রতিনিধি ড্যান গোল্ডম্যানের বিপরীতে।
মঙ্গলবার রাতের আগে থেকেই মামদানির প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুরু করেছিলেন। রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়া ভবিষ্যতে নিজের ভূমিকা নিয়ে পূর্বাভাস দিয়ে বলেন, তিনি নিজেকে 'নির্বাসিত মেয়র' ঘোষণা করবেন এবং মামদানি 'যখনই সীমা অতিক্রম করবেন', তখনই তিনি প্রতিবাদ করবেন। তার উদ্যোগগুলো থামানোর চেষ্টা করবেন। প্রয়োজনে সব ধরনের পদক্ষেপ নেবেন, শুধুমাত্র সহিংসতা বাদে।
অন্যদিকে, মামদানির প্রশাসনে সম্ভাব্য কয়েকজন সদস্য মনে করছেন—ট্রাম্প যদি শহরের জন্য তহবিল ছাঁটের হুমকি দেন বা আর কিছু করেন, তাতে তেমন প্রভাব পড়বে না।
তবে আপাতত আশা আছে। ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিনিধি রো খানা শেষ সপ্তাহান্তে কুইন্সে এসেছিলেন ভারতীয় মুসলিম ভোটারদের উদ্দেশ্যে এক সমাবেশে বক্তব্য দিতে। তিনি মামদানির মা, ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক মীরা নাইরের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিলেন, এবং মামদানির জয়ের পর হিন্দিতে বলেন, 'কোথা থেকে আপনি শুরু করেছিলেন, এখন কোথায় পৌঁছে গেলেন!'
