রামপুরায় নাদিম হত্যা মামলায় সাক্ষ্য দিলেন স্ত্রী, রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীর বক্তব্যে ট্রাইব্যুনালের অসন্তোষ
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর রামপুরায় পুলিশের গুলিতে নিহত মো. নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নিহা সাক্ষী হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জবানবন্দি দিয়েছেন।
এরপর তাকে এ মামলার পলাতক আসামি সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ চারজনের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন জেরা করেন। জেরার এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল আমির হোসেনকে বলেন, 'আপনি বেশি কথা বলেন। এমন এমন কথা বলেন যা আদালতের জন্য বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়।'
সোমবার (৩ নভেম্বর) বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর রামপুরায় ছাদের কার্নিশে ঝুলে থাকা আমির হোসেনকে গুলি করে হত্যাসহ দুইজনকে নিহত করার ঘটনায় দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তৃতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
তৃতীয় সাক্ষী হিসেবে এদিন জবানবন্দি দেন নিহত মো. নাদিম মিজানের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নিহা। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে প্রথমে আসামি এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকারের আইনজীবী সারওয়ার জাহান এবং পরে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন তাকে জেরা করেন।
জেরার একপর্যায়ে নিহাকে আমির হোসেন প্রশ্ন করেন, 'আপনার স্বামীকে কে গুলি করেছিল, আপনি কি তাকে দেখেছেন?'
এ প্রশ্নে আপত্তি জানিয়ে প্রসিকিউশন পক্ষ থেকে বলা হয়, 'একই প্রশ্ন আপনার আগের আইনজীবীও করেছেন। তখন আপনি ভেটো দিয়েছেন।'
তখন ট্রাইব্যুনাল আমির হোসেনকে বলেন, 'এতে আপনার লাভ কী হবে? তার স্বামী মারা গেছে- এটাই অ্যাভিডেন্স। এছাড়া আপনার আসামিদের নামও বলা হয়নি।'
জবাবে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী বলেন, 'মাই লর্ড! লাভের হিসাব অনেক দীর্ঘ। এ প্রশ্নে আমার আসামিদের লাভ হতেও পারে।' এ সময় তিনি বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন।
এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, 'আপনি বেশি কথা বলেন। এমন এমন কথা বলেন যা আদালতের জন্য বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়। এর আগেও আপনি একটা কথার জন্য ১০টা কথা টেনেছেন। আপনার এসব প্রশ্নে লাভ কী? তিনি (সাক্ষী নিহা) একজন ভুক্তভোগী। তার সাক্ষ্যে আপনার আসামিরা তো মুক্তি পেয়ে যাবে না।'
ট্রাইব্যুনাল আরও বলেন, 'আমরা যদি ভুল করি, তাহলে আপনাদের যাওয়ার সুযোগ আছে। আমরা তো একটা ওপিনিয়ন দিতেই পারি। এটা হলো একটা হেয়ারসে (শোনা) সাক্ষী। আর উনার স্বামী মারা গেছেন, এজন্যই সাক্ষ্যটা নেওয়া।'
ট্রাইব্যুনালের এমন মন্তব্যে সম্মতি জানিয়ে আমির হোসেন বলেন, 'জ্বি মাই লর্ড।' এরপর বাকি প্রশ্ন করে তিনি জেরা শেষ করেন।
এদিন সকাল ১১টা ২৭ মিনিটে সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন নাদিমের স্ত্রী তাবাসসুম আক্তার নিহা। তার সঙ্গে ছিল তিন বছরের ছেলে আনাস বিন নাদিম। শপথ পড়ে তিনি ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই স্বামী হত্যার পুরো বর্ণনা ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেন এবং স্বামীর হত্যার বিচার চান।
জবানবন্দিতে তাবাসসুম বলেন, 'গত বছরের ১৯ জুলাই তার স্বামী নাদিম জুমার নামাজ পড়তে রামপুরা থানার সামনের মসজিদে যান। বেলা আড়াইটার দিকে স্থানীয় লোকজন তার স্বামীকে গুলিবিদ্ধ ও রক্তাক্ত অবস্থায় বনশ্রী এলাকার তাদের বাসায় (তাবাসসুমের বাবার বাড়ি) নিয়ে আসেন।'
তিনি বলেন, 'আমি দেখতে পাই, আমার স্বামীর পেট থেকে রক্ত ঝরছে। স্বামীর এ অবস্থা দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। পাঁচ-দশ মিনিট পর জ্ঞান ফিরলে জানতে পারি, তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাইরে তখন অনবরত গুলি চলছিল, তাই আমি হাসপাতালে যেতে পারিনি। পরে জানতে পারি, হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক আমার স্বামীকে মৃত ঘোষণা করেন। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর থানার সামনে পুলিশ ও বিজিবির ছোড়া গুলি তার শরীরে লাগে।'
তিনি আরও বলেন, 'হাসপাতাল থেকে আমার স্বামীর লাশ বাসার নিচে আনা হয়। তখন রামপুরা থানার পুলিশ লাশ নিয়ে যেতে চায়। পরে নাদিমের লাশ দোতলার বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় বাসায় ও আশপাশে অনেক আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা জড়ো হয়। তখন হেলিকপ্টার থেকে বাড়ি ও ছাত্রজনতাকে লক্ষ্য করে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। আমার মা তখন ছাদে ছিলেন। টিয়ারশেল মায়ের শরীরে লাগতে গেলে আমার দুলাভাই মাকে রক্ষা করেন। টিয়ারশেল ছাদে পড়ে বিস্ফোরিত হয়।'
সেদিন রাত ১০টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে নাদিমের লাশ মিরপুর-১ নম্বর ঈদগাহ মাঠে নেওয়া হয় বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন তাবাসসুম। তিনি বলেন, 'জানাজা শেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে নাদিমের দাফন সম্পন্ন হয়।'
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলায় বর্তমানে গ্রেপ্তার রয়েছেন রামপুরা পুলিশ ফাঁড়ির সাবেক এএসআই চঞ্চল চন্দ্র সরকার।
পলাতক চার আসামির মধ্যে হাবিবুর রহমান ছাড়াও রয়েছেন খিলগাঁও জোনের সাবেক এডিসি মো. রাশেদুল ইসলাম, রামপুরা থানার সাবেক ওসি মো. মশিউর রহমান এবং এসআই তারিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। গত ১০ আগস্ট তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল।
