‘হাসিনা পালিয়ে গেছে, গুলি করছেন কেন’ বললেও এলোপাতাড়ি গুলি করেছে পুলিশ: ট্রাইব্যুনালে সাক্ষী
গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিকেলে আশুলিয়ায় আনন্দ মিছিলে অংশ নেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সেই আনন্দ বিভীষিকায় রূপ নেয়। মিছিলে উপস্থিত সানি মৃধার দুই পা ভেদ করে বেরিয়ে যায় পুলিশের চাইনিজ রাইফেলের গুলি। এছাড়া তার শরীরে শর্টগানের ছররারও ক্ষত রয়েছে। এখনও তার পায়ে সাপোর্টিং ডিভাইস ব্যবহার করতে হয়।
মিছিলে অংশ নেওয়া আন্দোলনকারীরা পুলিশের কাছে বলেন, 'হাসিনা পালিয়ে গেছে, আপনারা কেন এখনও গুলি করছেন।' এরপরও এলোপাতাড়ি গুলি চালানো বন্ধ হয়নি।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে সেদিনের বীভৎস ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন পুলিশের গুলিতে আহত ২৯ বছর বয়সী সানি মৃধা। গত বছরের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছয় মরদেহ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার মামলায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ১৬তম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় এদিন। সানি ২১ নম্বর সাক্ষী হিসেবে তার ক্ষতস্থান ট্রাইব্যুনালে দেখান। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
সানি মৃধা জবানবন্দিতে বলেন, ''আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একমত হয়ে আন্দোলনে যোগ দেই। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুরে বাইপাইল এলাকায় অবস্থান নেই। ২টা থেকে আড়াইটার দিকে জানতে পারি শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। তখন সবাই বিজয় মিছিল করি। ঠিক সেই মুহূর্তে আশুলিয়া থানার দিক থেকে অনেক গোলাগুলির শব্দ আসছিল। আমরা ছাত্র-জনতা সবাই মিলে থানার দিকে রওনা হই। একপর্যায়ে থানার কাছে গেলে পুলিশ আমাদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। আমরা তাদের উদ্দেশে বলতে থাকি, 'হাসিনা পালিয়ে গেছে, আপনারা কেন এখনও গুলি করছেন', কিন্তু তারা থামেনি।"
তিনি আরও বলেন, 'পুলিশের ছোড়া চাইনিজ রাইফেলের একটি গুলি আমার হাঁটুর ওপর কোমরের নিচে পায়ে লেগে পা ভেদ করে বেরিয়ে যায়। হাত ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে শর্টগানের ছররা গুলি লাগে। ১৭টি পিলেট বের করা হয়েছে, তবে ডান হাতের কনুইতে এখনও একটি রয়ে গেছে। ওই দিন আরও অনেকেই গুলিবিদ্ধ হন, যার মধ্যে একজন পরিচিত, তার নাম সজল।'
সাক্ষী বলেন, 'গুলি লাগার পর আন্দোলনরত এক ভাইকে আমাকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করি। তারা আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রথমে হাবিব ক্লিনিকে নেওয়া হয়, ভর্তি না হওয়ায় গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে নেন। এক্স-রে করার পর আমাকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এখানে এক মাস ১৭ দিন চিকিৎসাধীন থাকি। এরপর সিআরপি-এ তিন মাস চিকিৎসা নিই। সিআরপি থেকে ঢাকা সিএমএইচ-এ তিন-চার দিন, সর্বশেষে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। এখনও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারি না, ফিজিওথেরাপি নিতে হয়। ডান পায়ে সাপোর্টিং ডিভাইস (এএফও) ব্যবহার করি। দুই পায়ের নার্ভে অসহ্য ব্যথা আছে।'
মরদেহ পোড়ানোর বিষয়ে সানি বলেন, 'হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালীন ফেসবুক পোস্টে ভিডিওতে সহযোদ্ধা সজলকে আশুলিয়া থানার সামনে একটি ভ্যানে তুলতে দেখি। পুলিশ ভ্যানে তুলে অন্যদের সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।'
তিনি অভিযোগ করেন, 'তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের হুকুমে স্থানীয় এমপি সাইফুলসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালান। রনি ভূঁইয়া নামে একজনের হাতে আমি নিজে অস্ত্র দেখেছি। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যেন ভবিষ্যতে কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে জনগণের ওপর অত্যাচার করতে না পারে।"
সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে সানিকে জেরা করেন পলাতক আট আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবীসহ অন্যান্যরা। ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর ফারুক আহাম্মদ, সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর আবদুস সোবহান তরফদার ও প্রসিকিউটর আবদুস সাত্তার পালোয়ান। মামলায় এখন পর্যন্ত ২১ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী বুধবার (৫ নভেম্বর) দিন ঠিক করেছেন ট্রাইব্যুনাল-২।
এ মামলায় গ্রেপ্তার আট আসামিকে বৃহস্পতিবার সকালে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। তারা হলেন- ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মো. আব্দুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, এসআই মালেক, এসআই আরাফাত উদ্দিন, এএসআই কামরুল হাসান, আবজাল ও কনস্টেবল মুকুল। তবে সাবেক এমপি সাইফুলসহ আটজন এখনও পলাতক রয়েছেন।
