৬০ বছরেও ট্রেন্ডি শাহরুখ খান: ৯০ দশকের এই আইকন এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন
জেন জিদের জন্য ভেঙেচুরে ভিন্ন আঙ্গিকে নিজেকে রিমিক্সড করেছেন। আবার মিলেনিয়ালরা তাকে দেখেই বড় হয়েছে এবং বুমাররা তাকে বড় হতে দেখেছে।
ভারত এবং ভারতের বাইরে কোটি কোটি মানুষের কাছে, শাহরুখ খান (এসআরকে নামেও পরিচিত) এখনও হিন্দি চলচ্চিত্রের অন্যতম স্বীকৃত ও প্রভাবশালী আইকন হিসেবে পরিচিত।
এই বছরই ২ নভেম্বর ৬০ বছরে পা রাখছেন এই অভিনেতা। বছরটি তার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি এক বছর প্রথম ভারতীয় পুরুষ হিসেবে মেট গালা কার্পেটে পা রেখেছেন। তাছাড়া জুনে জনপ্রিয় গায়ক এড শিরানের 'স্যাফায়ার' গানের মিউজিক ভিডিওতে ক্যামিও ও অক্টোবরে রিয়াদে দক্ষিণ কোরিয়ার 'স্কুইড গেম' তারকা লি জং-জের সঙ্গে সেলফি তুলে ভাইরাল হন শাহরুখ। কিছু ভক্ত এগুলো 'শতাব্দীর সেরা কলাব' বলে অ্যাখ্যা দেন।
মরিশাস থেকে মায়ানমার পর্যন্ত গুগল ট্রেন্ডেসে তার সম্পর্কে অনুসন্ধান করে মানুষ। তাহলে প্রশ্ন হলো, তার সম্পর্কে এমন কি মিথ আছে যা সময়, প্ল্যাটফর্ম ও দেশ ছাড়িয়ে গেছে?
মিথের পেছনের মানুষটি
১৯৯২ সালে চলচ্চিত্র জীবন শুরু করার পর থেকে শাহরুখ ৮০টির বেশি ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ১৯৯৫ সালে দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে ছবিতে রোমান্টিক আইকন হিসেবে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি এখনও মুম্বাইয়ের হলে হাউসফুল। ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া চক দে! ইন্ডিয়াতে এক অপমানিত হকি কোচের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। ২০২৩ সালের জওয়ানে একজন ন্যায়ের নায়ক হয়ে সরকারি অকার্যকারিতা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ছেন তিনি। এ ছবির জন্য সেপ্টেম্বরে তিনি জীবনে প্রথমবারের মতো ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
জার্মান-ভাষার বলিউড-ফোকাসড ম্যাগাজিন ইশক-এর প্রধান সম্পাদক ভেরা ওয়েসেল তার সম্পর্কে বলেন, শাহরুখ খান এমন অনুভূতি জাগাতে পারেন যা অন্য কোনো অভিনেতা পারেন না — "এমনকি তার ভক্তরাও মাঝে মাঝে এ অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খান।"
একবার শাহরুখ খান মার্কিন টেলিভিশন হোস্ট ডেভিড লেটারম্যানকে রসিকতা করে বলেছিলেন, "আমি শাহরুখ খানকে নিয়ে গড়ে ওঠা মিথের একজন কর্মচারী।"
ভক্তদের চোখে শাহরুখ
অর্থনীতিবিদ (এবং শাহরুখ খান ভক্ত) শ্রায়না ভট্টাচার্য ২০২১ সালে প্রকাশিত তার বই 'ডেসপারেটলি সিকিং শাহরুখ: ইন্ডিয়া'স লোনলি ইয়ং উইমেন অ্যান্ড দ্য সার্চ ফর ইন্টিমেসি অ্যান্ড ইন্ডিপেন্ডেন্স'-এ শাহরুখের মিথে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।
তিনি শাহরুখকে "ন্যারেটিভ ডিভাইস" হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, শাহরুখ তার এ ক্ষমতা ব্যবহার করে বিভিন্ন বয়স ও সামাজিক স্তরের ভারতীয় নারীদের "বিশ্বের অন্যতম নিন্দনীয় পিতৃতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক ও মানসিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের হতাশাজনক প্রচেষ্টা" সম্পর্কে আলোচনা করতে বাধ্য করেছেন।
ভট্টাচার্য মনে করেন যে, পর্দায় যারা শাহরুখকে দেখেন তাদের বাস্তবতার মধ্য দিয়ে খানের ভাবমূর্তি প্রতিফলিত হয়।
একজন অভিবাসী উপজাতি গৃহকর্মীর জন্য, তার পর্দার যত্ন পূর্ণ অঙ্গভঙ্গি—গৃহকর্মে সাহায্য করা, নারীবাদী ক্ষেত্রে উপস্থিত থাকা—একটি বিরল স্বীকৃতি প্রদান করে, এমন একটি দেশে যেখানে পুরুষদের যত্নমূলক কাজের অংশগ্রহণ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম।
অভিজাতদের জন্য, তিনি ভারতের নব্য-উদারনৈতিক পরিবর্তনের সময় যোগ্যতার মিথকে তুলে ধরছেন।
প্রথম প্রজন্মের নারী পেশাজীবীদের জন্য তার চলচ্চিত্রগুলো বিয়ের চেয়ে ক্যারিয়ার বেছে নেওয়ার যে নীরব বিদ্রোহ, তা থেকে মানসিক স্বস্তি এনে দিয়েছিল।
ভট্টাচার্য ডয়েচে ভেলেকে বলেন, "আমি ১৫ বছর ধরে তার নারী ভক্তদের জীবন, জীবিকা এবং প্রেমকাহিনি অনুসরণ করেছি, তাই জানি যে শাহরুখের আইকন নিয়ে কোনো সরল তত্ত্ব নেই। তিনি একজন মানুষ, কিন্তু প্রতিটি ভক্ত নিজের নিজস্ব অনন্য ও গভীরভাবে বৈচিত্র্যময় উপায়ে তাদের আকাঙ্ক্ষা ও কল্পনা শাহরুখের উপর প্রতিফলিত করেছেন।"
জেন জিদের জন্য রিমিক্সড শাহরুখ
'৯০-এর দশকের বয় ব্যান্ডগুলোর বিশ্বস্ত ভক্তদের মতো, খান-এর অনেক ভক্ত তার সঙ্গে বড় হয়ে উঠেছেন এবং কখনও কখনও এই "ভক্তি" তাদের সন্তানদের মধ্যেও পৌঁছে দিয়েছেন। বিদেশে বসবাসরত ভারতীয়দের জীবনকে দেখানো তার চলচ্চিত্রগুলো বিশাল ভারতীয় প্রবাসী সম্প্রদায়ের সাথে গভীরভাবে সংযোগ স্থাপন করেছে। এ ভারতীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা প্রায় ৩.৫ কোটি। এর পাশাপাশি অ-ভারতীয় দর্শকদেরও হিন্দি সিনেমার সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে।
ভেরা ওয়েসেল বলেন, "ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ এবং একটি বিশাল বাজার হওয়ায়, আমি মনে করি না শাহরুখকে তার স্টারডম বাড়ানোর জন্য বিশেষ চেষ্টা করতে হবে।"
শিরানের স্যাফায়ার ভিডিওতে শাহরুখের ক্যামিও সম্পর্কে ভেরা ওয়েসেল বলেন, "আমি বেশ নিশ্চিত যে এড শিরানের মতো মানুষ তাকে চিনতে পারা এবং এখন তার সঙ্গে কাজ করা শুধুই স্বাভাবিক নয়, বরং তাদের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ।"
খান যেন জেন জিদের সঙ্গে সহজেই সংযোগ স্থাপন করছেন, ম্যাশআপ, মিম এবং টিকটকগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা দিচ্ছেন। এই সবের মধ্যে প্রায়ই তার চলচ্চিত্রের গানগুলো ব্যবহৃত হয়, যা তিনি লিপ-সিঙ্ক করেন — যেমনটি অনেক ভারতীয় ছবিতে হয় — এবং তার সিগনেচার স্টাইল প্রসারিত হাতের অঙ্গভঙ্গি এবং অভিব্যক্তিশীল চোখের মাধ্যমে আবেগ প্রকাশ করেন।
কানাডিয়ান ভারতীয় র্যাপার তেশেরের ২০২০ সালের ট্র্যাক "ইয়োং শাহরুখ", যা খানের ২০০১ সালের হিট ছবি কভি খুশি কভি গাম থেকে একটি গানের অনুরূপ তৈরি করেছেন। সেটি ইউটিউবে ২০ মিলিয়নের বেশি ভিউ পেয়েছে। শাহরুখ নিজেও এই গানে কয়েকবার নেচেছেন।
ঠিক একইভাবে, ব্রিটিশ গায়িকা ডুয়া লিপার ২০২০ সালের হিট "লেভিটেটিং" গানটি খানের ১৯৯৯ সালের ছবি বাদশাহ থেকে "ও লাডকি জো" গানটির সঙ্গে ম্যাশআপ করে গাওয়া গয়। লিপা গত বছর মুম্বাই কনসার্টে এই ভার্সনটি গান। ছবির নাচের ধাপও ভক্তদের উচ্ছ্বসিত করে। এ উচ্ছ্বসিত ভক্তদের মধ্যে ছিলেন শাহরুখ কন্যা ও ভারতীয় অভিনেত্রী সুহানাও। তিনি সেই মুহূর্তটি ইন্সটাগ্রামে শেয়ার করেন।
কালজয়ী আইকন
ভেরা ওয়েসেল বলেন, শাহরুখ-এর অব্যাহত প্রাসঙ্গিকতার কারণ তার ব্যবসায়িক দক্ষতা। তিনি প্রথম ভারতীয় তারকাদের মধ্যে একজন, যারা সফলভাবে অনলাইনে ভক্তদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছেন। বড় বড় ব্র্যান্ডের জন্য তার কাজ, যা তিনি প্রায়শই তার ৪.৮৮ কোটি ইন্সটাগ্রাম অনুসারীদের সামনে উপস্থাপন করেন, তাকে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক সফলতা এবং শক্তিশালী কণ্ঠস্বর প্রদান করেছে।
ভেরা ওয়েসেল বলেন, "এবং, যখনই তিনি সেই কণ্ঠ ব্যবহার করেন—হোক তা তার চলচ্চিত্রে বা জনসাধারণের অনুষ্ঠানে—তিনি সাধারণ শব্দ এবং সামান্য রসবোধের সঙ্গে আশা ও বোঝাপড়ার বার্তা ছড়িয়ে দেন।"
ওয়েসেল বলেন, শাহরুখ সম্ভবত ভবিষ্যতের ছবিতেও কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকবেন — "কারণ ট্রেন্ড যায় আসে, কিন্তু তার জনপ্রিয়তা কালজয়ী।"
