প্লাস্টিক বর্জ্যে সমুদ্র দূষণ করা শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ: প্রতিবেদন
পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করার প্রায় বিশ বছর পরও প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বাংলাদেশ। বাজারের ব্যাগ থেকে শুরু করে খাবারের মোড়ক, ফেলে দেওয়া বেশিরভাগ জিনিসেরই শেষ গন্তব্য হচ্ছে নদী ও সাগর—বিশ্বব্যাপী এই দূষণ সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা গ্রিনম্যাচের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমুদ্রের প্লাস্টিক দূষণে এশিয়ার দেশগুলোই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে, যা মোট সামুদ্রিক বর্জ্যের প্রায় ৮১ শতাংশ।
শীর্ষ দশ দূষণকারীর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে প্রবেশ করে।
প্রতি বছর শীর্ষ দূষণকারী দেশগুলো হলো: ফিলিপাইন (৩ লাখ ৬০ হাজার টন), ভারত (১ লাখ ৩০ হাজার টন), মালয়েশিয়া (৭৩ হাজার টন), চীন (৭১ হাজার টন), ইন্দোনেশিয়া (৫৬ হাজার টন), মিয়ানমার (৪০ হাজার টন), ব্রাজিল (৩৮ হাজার টন), ভিয়েতনাম (২৮ হাজার টন), বাংলাদেশ (২৫ হাজার টন) ও থাইল্যান্ড (২৩ হাজার টন)।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতিমধ্যেই ৭৫ থেকে ১৯৯ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক সাগরে জমা হয়েছে, যা সামুদ্রিক জীবন ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে।
অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক শরিফ মুস্তাজিব বাংলাদেশের প্লাস্টিকের জীবনচক্র নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, দেশে প্লাস্টিক দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো দুর্বল তদারকি।
এই গবেষক বলেন, 'নানা উৎস থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে পৌঁছায়। এর কোনো সঠিক তথ্য নেই। আর সিটি কর্পোরেশনগুলো প্লাস্টিককে সাধারণ বর্জ্য গণ্য করে, যা ব্যবস্থাপনা করার সক্ষমতা তাদের নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর পারমিট দিলেও উৎপাদন বা নিষ্পত্তি পর্যবেক্ষণ করে না। চিপসের প্যাকেট, বোতল বা পলিথিন রিসাইকেল করার প্রযুক্তিও আমাদের নেই।'
বাড়ছে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঝুঁকি
বিশ্বব্যাপী মানুষের খাওয়া মাছের ৬০ শতাংশের মধ্যেই প্রায় ৯২ শতাংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যা ক্যানসার, বন্ধ্যত্ব ও স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতির ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
গ্রিনম্যাচের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একজন মানুষ বছরে গড়ে ২ লাখ ১১ হাজার পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করতে পারে। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো মানুষের ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড এমনকি মস্তিষ্কেও পাওয়া গেছে।
চলতি বছরের শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক এক কর্মশালায় অধ্যাপক শাহ নেওয়াজ চৌধুরী সতর্ক করে বলেন, সমুদ্রে ফেলে দেওয়া মাছ ধরার জাল সামুদ্রিক দূষণের একটি প্রধান উৎস।
তিনি বলেন, 'এই গোস্ট নেট প্রায়ই সমুদ্রের তলায় ডুবে যায়, যা পরে ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয় এবং মাছের মাধ্যমে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে। এতে ক্যান্সার, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও বন্ধ্যত্বের মতো স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়।'
অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ১৯ হাজার নৌকা ও ট্রলার বছরে প্রায় ৪০ হাজার টন প্লাস্টিকের জাল ব্যবহার করে, যার প্রায় ৭ শতাংশ সমুদ্রে পরিত্যক্ত হয়।
অধ্যাপক শাহ নেওয়াজ আরও বলেন, 'মাছ, শেলফিশ এমনকি কচ্ছপের পেটেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। জেলেরা প্রায়ই তাদের জাল সাগরে ফেলে আসেন, যা দূষণকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। পোশাক, প্রসাধনী ও গৃহস্থালি সামগ্রী থেকেও মাইক্রোপ্লাস্টিক সাগরে প্রবেশ করছে, যা জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।'
দূষণের পেছনে দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা বাড়লেও এর বাস্তবায়ন এখনও খুবই দুর্বল।
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান টিবিএসকে বলেন, এই সমস্যার মূলে রয়েছে দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা।
তিনি বলেন, 'আমাদের ব্যবহারের মাত্রা বেশি, কিন্তু ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা দুর্বল। যদিও পলিথিন আগেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, তবে এর প্রয়োগ ছিল দুর্বল। বাস্তবায়ন জোরদার করতে আমরা এখন র্যাবকে সম্পৃক্ত করেছি।'
তিনি আরও বলেন, সুপারমার্কেট ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
'জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের মাধ্যমে আমরা ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প গ্রহণের পরিকল্পনা করছি,' বলেন তিনি।
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও পলিথিন ও অন্যান্য একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক সারা দেশে এখনও সহজলভ্য। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্বল আইন ও প্রয়োগের অভাবের কারণে এই নিষেধাজ্ঞা বহুলাংশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, আরও কঠোর আইন, উন্নত রিসাইক্লিং ব্যবস্থা ও জনসচেতনতা বাড়ানো না গেলে দেশের প্লাস্টিক সংকট আরও গভীর হবে। এতে আরও বিপন্ন হবে সামুদ্রিক জীবন ও জনস্বাস্থ্য।
