ভেঙে পড়ছে কুয়াকাটার সবুজ বেষ্টনী: প্রতিবছর মারা যাচ্ছে হাজারো গাছ

মরে যাওয়া গাছের শাখা ভেঙে আটি বাঁধছিলেন মাঝবয়সী রুবেল সিকদার। প্রায় প্রতিদিনই গঙ্গামতি এলাকায় কাঠ সংগ্রহে আসেন তিনি। জ্বালানির চাহিদা মেটাতে এই বনের শুকনো গাছগুলো কাজে লাগলেও গাছ মরে যাওয়া নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ দেখালেন রুবেল।
তিনি বলেন, "ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে গাছগুলো আমাদের বাঁচিয়ে রাখে। বঙ্গোপসাগর থেকে যত বড় ঢেউ আসুক, গঙ্গামতির গাছগুলো ঢাল হয়ে দাঁড়ায়। সিডর, আইলা, আম্পান, সিত্রাং, রেমাল—এসব ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়েছে। কিন্তু এখন প্রতিদিনই দেখি গাছ মারা যাচ্ছে। কী কারণে যে মরছে, কিছুই বুঝতে পারছি না।"
রুবেলের মতো একই প্রশ্ন তুলেছেন কুয়াকাটা ভ্রমণে আসা সঞ্জীব শীল। তিনি বলেন, "অনেক আগে শুনেছিলাম কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান আছে। কিন্তু এসে কিছুই দেখলাম না। গঙ্গামতি, কাউয়ার চর, লেম্বুর বন, ঝাউবন, তিন নদীর মোহনা—সব জায়গায় অসংখ্য গাছ মরে গেছে। কুয়াকাটার সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে গেছে।"
বন বিভাগের তথ্যে জানা গেছে, কুয়াকাটায় গত পাঁচ বছরে মোট বনভূমির এক-তৃতীয়াংশ হারিয়ে গেছে। এর কিছু অংশ হারিয়েছে ভাঙনে, কিছু দখলদারদের কারণে, আর একটি বড় অংশ এখন মারা যাচ্ছে। নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও প্রতি বছর ১২ থেকে ১৫ হাজার গাছ মারা যাচ্ছে বলে ধারণা। এতে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে কুয়াকাটা।

পটুয়াখালীর উপকূলীয় বন বিভাগের মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, "খাজুরা থেকে গঙ্গামতি পর্যন্ত আগে ছিল ১,৬০০ হেক্টর বনভূমি। বর্তমানে ১,১০০ হেক্টর টিকে আছে। গত পাঁচ বছরে ৫০০ হেক্টর বনভূমি হারিয়ে গেছে।"
জানা গেছে, সৈকতের ভাঙন ঠেকাতে আর সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৫ সালে কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে দুই কিলোমিটার পূর্বে কুয়াকাটা ইকোপার্ক নির্মিত হয়।
২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর পার্কটিকে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যান নামকরণ করা হয়। তবে ১৪ বছরে সেই উদ্যান বিলীন হয়ে গেছে ভাঙনে। কিছু অংশ টিকে থাকলেও এখন গাছগুলো মরে যাচ্ছে।
কি কারণে মারা যাচ্ছে গাছ?
কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতের পূর্ব ও পশ্চিম অংশে ঘুরলেই চোখে পড়ে হাজারো মৃত গাছ। মাঝারি থেকে বড় সব ধরনের গাছই ধ্বংসের মুখে পড়েছে। বিশেষ করে কেওড়া, ছৈলা, ঝাউ, পাইনসহ উপকূলীয় সহনশীল গাছগুলো দ্রুত মারা যাচ্ছে।
পটুয়াখালীর উপকূলীয় বন বিভাগের কর্মকর্তা মো. তারিকুল ইসলাম বলেন, "কয়েক বছর ধরে কুয়াকাটা সৈকতসংলগ্ন এলাকায় প্রচুর মাটি ক্ষয় হচ্ছে। পাশাপাশি সমুদ্র দূষণের কারণে পানির উচ্চতা বেড়ে গিয়ে জোয়ারের সময় পানি বনাঞ্চলে ঢুকে পড়ে। পানির সঙ্গে ভেসে আসা বালু গাছের শ্বাসমূল ঢেকে দেওয়ায় গাছগুলো খাবার নিতে পারে না, ফলে মারা যায়।"

তিনি আরও বলেন, "দূষণের কারণে যেভাবে সমুদ্রের তলদেশ উপরে উঠে আসছে, তাতে আগামী পঞ্চাশ বছর পর কুয়াকাটা টিকে থাকবে কি–না তা নিয়েই শঙ্কা আছে। মানুষই প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। ফলে ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বিভিন্ন কারণে গাছগুলো মারা যাচ্ছে।"
বন বিভাগের মহিপুর রেঞ্জের সাবেক কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, "আমি দীর্ঘদিন কুয়াকাটায় কাজ করেছি। সেখানে গাছ মারা যাওয়ার বড় কারণ স্যালাইন ওয়াটার। এটি শ্বাসমূলে ঢুকে গাছের মৃত্যু ত্বরান্বিত করে। এর সঙ্গে দূষণ তো আছেই। যে হারে গাছ মারা যাচ্ছে, তাতে কতদিন এসব বন টিকে থাকবে, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।"
উপকূল পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের (উপরা) আহ্বায়ক কেএম বাচ্চু বলেন, "কুয়াকাটার জন্য অশনিসংকেত হচ্ছে আমাদের সবুজ বেষ্টনীর গাছগুলো মারা যাওয়া। পর্যটন এলাকায় হাজারো গাছ মরে আছে। এই মৃত্যুর জন্য প্রাকৃতিক কারণের চেয়ে মানবসৃষ্ট কারণই বেশি দায়ী। জোয়ারের পানির উচ্চতা বেড়ে বনে পানি ঢুকে যায়, পানির সঙ্গে ভেসে আসা বালু শ্বাসমূল আটকে দেয়। যেসব গাছের গোড়ায় সাদা বালু জমে, সেগুলো দ্রুত মারা যায়।"
তিনি অভিযোগ করেন, "বন বিভাগের উদাসীনতা বা দুর্বলতার কারণে বন সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। এ সুযোগে বনখেকোরা বনে ঢুকে আগুন লাগায়, গাছের কাণ্ড কেটে মৃত্যু ত্বরান্বিত করে। গাছটি মারা গেলে সেটি কেটে নিয়ে যায়। কুয়াকাটায় বন উজাড়ে বিভিন্ন স্তরে একটি চক্র কাজ করছে।"
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ ও ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, "আমি ঢালাওভাবে জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করতে চাই না। ১৯৯৯ সালে কুয়াকাটার শোরলাইন ছিল বর্তমান বেড়িবাঁধ থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে। কিন্তু ভাঙনের কবলে পড়ে সেটি এখন বেড়িবাঁধের পাদদেশে চলে এসেছে।"
তিনি বলেন, "স্যালাইনিটির কারণে গাছ মারা যেতে পারে। কুয়াকাটার ফার্স্ট লাইন ডিফেন্স ভেঙে ফেলা হয়েছে। বায়োডাইভারসিটি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দূষণ বাড়ছে। অথচ এ বিপর্যয় ঠেকাতে কারও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।"

"কনজারভেশন প্র্যাকটিস বাদ দিয়ে প্রকৃতিকে বিরক্ত করলে ফার্স্ট লাইন ডিফেন্স ভেঙে প্রতিকূল পরিবেশ তৈরি হবেই। বড় কারণ হচ্ছে, আমরা কোনো ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করি না। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ কুয়াকাটায় আসে। অথচ এই ছোট জায়গায় কত মানুষের ধারণক্ষমতা, তা ম্যানেজমেন্ট জানে না। ফলে কুয়াকাটার ইকোসিস্টেম ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে," যোগ করেন তিনি।
এদিকে, সংকট মোকাবিলায় বন বিভাগ বিকল্প জমিতে নতুন বন সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। মো. তারিকুল ইসলাম জানান, "গত পাঁচ বছরে আমরা ১০ লাখেরও বেশি চারা রোপণ করেছি। তবে স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া গাছের মৃত্যু রোধ করা এবং বন রক্ষা করা সম্ভব হবে না।"