মেট্রোরেলের ত্রুটি বারবার নজরে এলেও কেন সমাধান হয়নি?
এক বছর আগে মেট্রোরেলের স্ট্রাকচার থেকে বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ার ঘটনাটি কর্তৃপক্ষের জন্য একটি সতর্কবার্তা হওয়া উচিত ছিল। ঢাকার মতো জনবহুল শহরে এমন গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণের সময়ই সম্ভাব্য সব ত্রুটি–বিচ্যুতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা দরকার ছিল।
তবু আবারও একই ঘটনা ঘটল—আর এবার তা হলো প্রাণঘাতী। গতকাল (২৬ অক্টোবর) দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে ফার্মগেট স্টেশনের কাছে ৪৩৩ নম্বর পিয়ারের একটি লোড-বিয়ারিং প্যাড খুলে নিচে পড়ে যায়। এতে এক পথচারী ঘটনাস্থলেই নিহত হন; আহত হন আরও দুজন।
ঠিক একইভাবে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেট স্টেশন সংলগ্ন ৪৩০ নম্বর পিয়ারের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে যায়। সে সময় কোনো হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও প্রায় ১১ ঘণ্টা বন্ধ থাকে মেট্রোরেল চলাচল।
মেট্রোরেলের এমআরটি-৬ প্রকল্পের নির্মাণকাজ ২০১৬ সালে শুরু হওয়ার পর থেকেই এর কাজের মান ও নির্মাণ ত্রুটি নিয়ে নানা সময় সমালোচনা হয়েছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের পরীক্ষায় প্রকল্পটিতে নিম্নমানের বিয়ারিং প্যাড সরবরাহের বিষয়টি প্রকাশ পায়।
এক বছরের মাথায় একই স্থানে একইরকম দুর্ঘটনা ঘটায় মেট্রোরেলের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ ঘটনার মূল দায় মেট্রোরেল নির্মাণের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনট্রাক্টররা সাধারণত সুযোগসন্ধানী; তারা প্রায়ই নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু পরামর্শকের দায়িত্ব ছিল সঠিক নির্মাণপদ্ধতি ও নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করা এবং তা কঠোরভাবে তদারকি করা।
অন্যদিকে, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এখনো দুর্ঘটনার কারণ সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তারা এর বিস্তারিত প্রতিবেদন দেবেন।
তদন্ত কমিটি হলেও ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই
২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ফার্মগেটের একটি পিয়ার থেকে বিয়ারিং প্যাড ছিটকে পড়ার পর কারণ অনুসন্ধান এবং ভবিষ্যতে এমন ঘটনা এড়াতে করণীয় নির্ধারণে তৎকালীন ডিএমটিসিএল পরিচালক আব্দুল বাকি মিয়াকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তবে এরপর কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, এমনকি কোথায় ত্রুটি ছিল সেটিও সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা যায়নি।
আগের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমটিসিএল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আগের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী আমরা সব পর্যবেক্ষণ করেছি এবং বিশেষজ্ঞদের দিয়েও তা যাচাই করিয়েছি। তখন ডিফেক্ট লাইবিলিটি অনুযায়ী সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তাই কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, ত্রুটিগুলো সংশোধন করা হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এখন আমরা পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তারা দুই সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দেবে, সেই অনুযায়ী আমরা পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।"
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও ডিএমটিসিএল বোর্ড ডিরেক্টর ড. মো. হাদিউজ্জামান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "গত বছরের ও এবারের দুর্ঘটনা একই ধরনের এবং নকশাগত ত্রুটির কারণেই ঘটতে পারে। এখানে মেট্রো কর্তৃপক্ষের সচেতনতার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গত বছরের দুর্ঘটনার পর পুরো করিডোরের—বিশেষ করে নকশা ও বিয়ারিং প্যাডের—অডিট হওয়া দরকার ছিল। ব্যবহৃত বিয়ারিং প্যাডগুলো র্যান্ডমভাবে পরীক্ষা করে মান ও উপযুক্ততা যাচাই করা উচিত ছিল।"
ড. হাদিউজ্জামান আরও বলেন, "আগের দুর্ঘটনার পর তদন্ত কমিটি কী সুপারিশ করেছিল এবং কোন ত্রুটিগুলো উঠে এসেছিল, সে বিষয়ে আমিও জানি না। আসলে এই তদন্ত কমিটি গঠন নিয়েই সমস্যা আছে—যারা মেট্রোরেল প্রকল্পের উন্নয়ন ও তদারকির দায়িত্বে, তারাই তদন্ত কমিটিতে থাকেন। ফলে দুর্ঘটনার মূল কারণ ও ত্রুটিগুলো জনসমক্ষে আসে না।"
তিনি আরও বলেন, "ফার্মগেট মেট্রোরেলের ওই অংশে বেশ কয়েকটি বাঁক রয়েছে, যেখানে বিয়ারিং প্যাড ব্যবহার করা হলেও সেগুলোর জন্য পর্যাপ্ত সাপোর্ট দেওয়া হয়নি। ফলে মেট্রোরেল চলাচলের সময় সৃষ্ট ঝাঁকির কারণে প্যাডগুলো সরে যায়। আর যদি একই সঙ্গে তিন–চারটি বিয়ারিং প্যাড সরে যায়, তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে—উপর দিয়ে চলাচল করা মেট্রোরেলও বিপদের মুখে পড়তে পারে।"
লোড-বিয়ারিং প্যাড কী?
২০২০ সালের শুরুর দিকে বুয়েটের ল্যাবে পরীক্ষায় উত্তরা–আগারগাঁও অংশের দুটি প্যাকেজে ব্যবহারের জন্য আমদানি করা বিয়ারিং প্যাডের মান নিম্নমানের বলে প্রমাণিত হয়।
এসব প্যাড সরবরাহ করেছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতাল-থাই। বুয়েট তখন বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানালেও মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ সেই প্যাডই ব্যবহার করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিয়ারিং প্যাড সেতু বা ফ্লাইওভারের জন্য এক ধরনের কুশনের মতো কাজ করে। কোনো গাড়ি চলাচলের সময় তার ওজন বা চাপ সরাসরি পিয়ারে না গিয়ে প্যাডের ওপর পড়ে। বিয়ারিং প্যাড সেই চাপ সমানভাবে পিয়ারের ওপর ছড়িয়ে দেয়, ফলে সেতু বা ফ্লাইওভারের গায়ে অতিরিক্ত ঝাঁকুনি লাগে না।
তবে হাজার টন ওজনের মেট্রোরেলের ডেক বা ট্র্যাক এই প্যাডের ওপর বসানো থাকলেও বাঁক বা উঁচু–নিচু অংশে এগুলোর কার্যকারিতা কমে যায় বলে জানান অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান।
তিনি বলেন, সোজা লাইনে প্যাড ঠিকভাবে কাজ করলেও বাঁকে সেটি সরে যেতে পারে। তাই এমন জায়গায় পট ব্রিজ বিয়ারিংস (Pot Bridge Bearings) ব্যবহার করা বেশি কার্যকর।
'গুণগত পরামর্শের জন্য অর্থ দিচ্ছি, কিন্তু সেই মানের পরামর্শ পাচ্ছি না'
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই ঘটনাটি প্রমাণ করে আমরা গুণগত পরামর্শের জন্য অর্থ দিচ্ছি, কিন্তু সেই মানের পরামর্শ পাচ্ছি না। এটা নির্মাণে গাফিলতির স্পষ্ট প্রতিফলন।"
"আমি বলব, স্প্রিং বা বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়া মানে সরাসরি নির্মাণ ত্রুটি। এর স্থায়িত্ব নির্ভর করবে পরীক্ষার ফলাফলের ওপর। যদি দেখা যায় নির্ধারিত মানের স্প্রিং বা বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়নি, তাহলে ভবিষ্যতে এটি নির্ধারিত সময় পর্যন্ত টিকবে না—এটাই আরেকটি ঝুঁকি," বলে তিনি।
ড. মো. শামসুল হক আরও বলেন, "বিয়ারিং প্যাডের মান খারাপ হলে সেটা স্থায়িত্বের ব্যাপার। কিন্তু এখানে ভালো–খারাপ ম্যাটেরিয়ালের প্রশ্ন নয়—যা জায়গামতো থাকার কথা, সেটা পড়ে যাচ্ছে। পরপর দুইবার এমন ঘটনা ঘটেছে, ফলে সন্দেহ জাগে যে অন্যান্য স্থানেও কোয়ালিটি কন্ট্রোলে ঘাটতি রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "আমি এই ঘটনায় কনসালট্যান্টকেই দায়ী করব। কারণ কনট্রাক্টররা সাধারণত সুযোগসন্ধানী—তারা নিম্নমানের জিনিস দিতে চায়। কিন্তু কনসালট্যান্টের দায়িত্ব ছিল সঠিক নির্মাণপদ্ধতি ও নিরাপত্তা মেনে কাজ হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা।"
তিনি বলেন, "আমরা মেট্রোরেল আগে করিনি বলে জাপানি কনসালট্যান্টদের নিয়েছি, যারা অভিজ্ঞ ও পেশাদার। তাদের পরামর্শ সেবার জন্য আমরা বিপুল অর্থ ব্যয় করেছি। কিন্তু তারা গুণগত মান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে—এখন দায় তাদেরই নিতে হবে।"
সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, "এখনই একটি পূর্ণাঙ্গ সেফটি অডিট করা উচিত, এবং তা কনসালট্যান্টদের খরচে সম্পন্ন করা প্রয়োজন। কারণ আমরা পরামর্শ ও নির্মাণ—দুই ক্ষেত্রেই বিপুল অর্থ ব্যয় করেও নিরাপদ অবকাঠামো পাইনি। এই দায় সম্পূর্ণ কনসালট্যান্টের, আংশিকভাবে ডিএমটিসিএল-এর, কারণ তারাও সঠিকভাবে তদারকি করতে পারেনি।"
তিনি আরও বলেন, "আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, জাপানি কনসালট্যান্টরা অতিমূল্যায়িত ফি নিয়ে বাংলাদেশে আসে, কিন্তু যথাযথ পেশাদার জনবল পাঠায় না।"
তার মতে, "এখন আমাদের প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়ায় যেতে হবে এবং ইআরডির মাধ্যমে এমন শর্ত সংযোজন করতে হবে, যাতে পরামর্শকরা দায়বদ্ধ থাকে। অন্যান্য দেশেও ফান্ডিং এজেন্সিগুলো ভালো কনসালট্যান্ট পাঠায়, কিন্তু এখানে নন-টেকনিক্যাল লোকজনের মাধ্যমে কাজ করানো হচ্ছে।"
