ফিলিস্তিনি শরণার্থী থেকে রসায়নে নোবেল জয়ী কে এই ওমর ইয়াঘি

২০২৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন সাসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন ও ওমর এম ইয়াঘি। তারা এই পুরস্কার অর্জন করেছেন ধাতব-জৈব কাঠামো (মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্কস) আবিষ্কারের জন্য তাদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
বুধবার (৮ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় বিকেল পৌনে ৪টার দিকে নোবেল কমিটি এ পুরস্কার ঘোষণা করে। রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেস জানিয়েছে, রসায়নে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী এক ধরনের নতুন আণবিক কাঠামো উদ্ভাবন করেছেন।
সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানায়, 'তাদের তৈরি এই কাঠামো—ধাতু-জৈব ফ্রেমওয়ার্ক (মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক)—এর মধ্যে বড় বড় ফাঁপা স্থান রয়েছে, যেখানে অণুগুলো অবাধে প্রবেশ ও বের হতে পারে। গবেষকরা এই কাঠামো ব্যবহার করছেন মরুভূমির বাতাস থেকে পানি আহরণে, পানির দূষণকারী উপাদান অপসারণে, কার্বন ডাই-অক্সাইড ধারণে এবং হাইড্রোজেন সংরক্ষণে।'
কে এই ওমর ইয়াঘি
রসায়নে নোবেল বিজয়ী ওমর ইয়াঘি ছোটবেলায় কখনো ভাবেননি তিনি রসায়ন বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা করবেন। এক ফিলিস্তিন শরণার্থী পরিবারের সন্তান ইয়াঘির ছোটবেলা কেটেছে জর্ডানের আম্মানে। শৈশব কষ্টে ভরা, তবু সেই কষ্টের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল তার জীবনভর কৌতূহল।
নোবেল কমিটিকে ইয়াঘি বলেন, 'আমার বাবা-মা ছিলেন প্রায় নিরক্ষর। এটি ছিল এক দীর্ঘ যাত্রা—বিজ্ঞানই আমাকে এই পথ দেখিয়েছে।'
কমিটির তথ্য অনুযায়ী, আম্মানে বিদ্যুৎ ও পানিহীন এক ঘরে অনেক ভাই-বোনের সঙ্গে গাদাগাদি করে বড় হয়েছেন ইয়াঘি। স্কুলই ছিল তার জীবনের একমাত্র আশ্রয়।
তাদের এলাকায় প্রতি ১৪ দিনে কয়েক ঘণ্টার জন্য পানি আসত। ভোরে উঠে কল না খুললে, ইয়াঘির পরিবার—এমনকি তাদের গরুটিও পানি পেত না। সেই ভোরবেলা পানির জন্য অপেক্ষা করতে করতে তিনি শিখেছিলেন অভাবের মানে—জীবনের সবচেয়ে দরকারি জিনিসটাও না পাওয়ার যন্ত্রণা।
দশ বছর বয়সে একদিন, সাধারণত তালাবদ্ধ থাকা স্কুলের লাইব্রেরিতে গোপনে ঢুকে সে একটি এলোমেলো বই তুলে নেয়। সেই বইয়ের পাতায় আঁকা অদ্ভুত, জটিল চিত্রগুলো তাকে মুগ্ধ করে। সেই প্রথম, বিজ্ঞান ও কল্পনার জগতের প্রতি তার আগ্রহের সূচনা হয়।
সেই বইয়ের চিত্রগুলো ছিল অণুর কাঠামো, যা তাকে প্রথমবারের মতো এমন এক অদৃশ্য জগতের সঙ্গে পরিচয় করায়—একদিন যে জগতই তাকে নোবেলজয়ী করে তুলবে।
'দ্য নোবেল প্রাইজ' অনুসারে, ইয়াঘির জীবন আবারও বড় পরিবর্তন আসে ১৫ বছর বয়সে। বাবার কড়া হুকুমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পড়তে যান। রসায়নে মুগ্ধ হয়ে তিনি নতুন পদার্থ তৈরি করার শিল্পে মগ্ন হন। তবে তিনি হতাশ হয়েছিলেন প্রথাগত রাসায়নিক সংমিশ্রণের অনিশ্চয়তায়।
সাধারণত রসায়নবিদরা প্রতিক্রিয়াশীল পদার্থ এক সাথে মিশিয়ে তাপে রাখেন এবং প্রয়োজনীয় যৌগ পেতে গিয়ে প্রায়ই অপ্রয়োজনীয় বাই-প্রোডাক্ট উৎপন্ন হয়। ইয়াঘি খুঁজতে থাকেন একটি নিয়ন্ত্রিত, যৌক্তিক পদ্ধতি যা লেগো সেটের মতো নির্ভুলভাবে পদার্থ তৈরি করতে পারে।
১৯৯২ সালে অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে একজন তরুণ গবেষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ইয়াঘি নতুন পদার্থ তৈরি করার পরিকল্পনা শুরু করেন। তিনি চেয়েছিলেন রাসায়নিক উপাদানগুলোকে পরিকল্পিত, মডুলার পদ্ধতিতে সংযুক্ত করে উপাদান তৈরি করতে। তার দল অবশেষে সফল হয়; তারা ধাতব আয়ন ও জৈব অণুকে মেলাতে শুরু করেন এবং নিয়ন্ত্রিত ও জালের মতো কাঠামো তৈরি করেন।
১৯৯৫ সালে তিনি দুটি দ্বি-মাত্রিক (টুডি) পদার্থের কাঠামো প্রকাশ করেন, যা তামা বা কোবাল্ট দিয়ে বাঁধা। আশ্চর্যজনকভাবে কোবাল্ট-বাঁধা কাঠামোতে অন্য অণু রাখা সম্ভব এবং এটি ৩৫০°সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে, তবুও তার আকার হারায় না।
তার 'ন্যাচার' জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধে ইয়াঘি এই কাঠামোর নাম দেন 'মেটাল-অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক' (এমওএফ)। আজ এটি ধাতু ও কার্বন-ভিত্তিক অণু দিয়ে তৈরি স্ফটিকাকার, ফাঁপা কাঠামো বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
কয়েক গ্রামেই এক ফুটবল মাঠ
১৯৯৯ সালে ইয়াঘি পরিচয় করান এমওএফ-৫, এমন একটি পদার্থ যা ম্যাটেরিয়াল রসায়নকে সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তন করে দেয়। অত্যন্ত স্থিতিশীল ও প্রশস্ত এই এমওএফ-৫ ফাঁকা অবস্থায়ও ৩০০°সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে।
কিন্তু বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে অবাক করেছিল এর অদৃশ্য বিস্তৃতি। মাত্র কয়েক গ্রাম পদার্থেই ফুটবল মাঠের সমান পৃষ্ঠতল লুকিয়ে আছে। এই বিশাল ক্ষমতার কারণে এটি গ্যাস শোষণ করতে পারে আগের পদার্থ যেমন জিওলাইটির তুলনায় অনেক বেশি দক্ষভাবে।
এরপরই গবেষকরা তৈরি করতে শুরু করেন 'সফট এমওএফ'জ", অর্থাৎ নমনীয় কাঠামো যা নিজের মধ্যে থাকা বস্তু অনুযায়ী বিস্তৃত বা সংকুচিত হতে পারে।
এদের মধ্যে ছিলেন জাপানি বিজ্ঞানী সাসুমু কিতাগাওয়া। তিনি এমন একটি পদার্থ তৈরি করেছিলেন যা জল বা মিথেন দিয়ে পূর্ণ হলে আকার পরিবর্তন করে এবং খালি হলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে; এক ধরনের 'ফুসফুসের মতো' যেটি নিঃশ্বাসের সাথে গ্যাস ভেতরে নিতে পারে-বের করতে পারে, পরিবর্তনশীল কিন্তু স্থিতিশীল।
ওমর ইয়াঘির জন্য ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিশুর জীবন থেকে নোবেলজয়ী রসায়নবিদে যাত্রা কেবল বৈজ্ঞানিক সাফল্যের গল্প নয়; এটি সহনশীলতা, কল্পনা ও আশা নিয়ে গড়া এক জীবনগাঁথা। তার জীবন ও কাজ প্রমাণ করে, সীমিত সুযোগ থেকেও অসীম আবিষ্কার সম্ভব। আর দেখিয়ে দেয়, মানুষের কৌতূহল কতদূর যেতে পারে— এমনকি নির্বাসিত জীবন থেকেও।