চট্টগ্রাম বন্দর বিপুল মুনাফায়, তবু কেন বাড়ল মাশুল

প্রথমে মনে হতেই পারে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) সাম্প্রতিক মাশুল বৃদ্ধি ছিল দীর্ঘদিনের বিলম্বিত সমন্বয়। কারণ, ১৯৮৬ সালের পর থেকে বন্দরের ডলার-ভিত্তিক হারগুলো কখনও বাড়ানো হয়নি। কিন্তু যা সিপিএ প্রকাশ্যে বলছে না, তা হলো—এই সময়ে টাকার মান ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ায় তাদের আয় আগেই বহুগুণ বেড়ে গেছে।
১৯৮৬ সালে এক ডলারের বিনিময়ে পাওয়া যেত ২৭ টাকা, আজ তা প্রায় ১২২ টাকা। ট্যারিফ না বাড়িয়েই বন্দরের টাকায় আয় চার গুণেরও বেশি বেড়েছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর ২,৯১৩ কোটি টাকার রেকর্ড মুনাফা করেছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে—অর্থনীতি যখন টালমাটাল, ব্যবসায়ীরা চাপে, রপ্তানিকারকরা যখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই করছে—তখনই কেন এই ট্যারিফ বা মাশুল বাড়ানো হলো?
আইএফসি'র ভূমিকা ও নীতিগত প্রভাব
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর হাতে আসা নথি অনুযায়ী, নতুন ট্যারিফ কাঠামোটি বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতের শাখা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি)-এর প্রস্তাবিত কাঠামোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিলে যায়। সরকার ও সিপিএ-র পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে আইএফসি পতেঙ্গা ও লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের জন্য কনসেশন চুক্তি তৈরি করেছে।
তাদের মূল লক্ষ্য ছিল—চট্টগ্রাম বন্দরকে বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলা। সমালোচকদের অভিযোগ, এর ফলে ট্যারিফের এই কাঠামো সিপিএ'র চেয়ে বিদেশি অপারেটরদের বেশি সুবিধা দিচ্ছে।

সমালোচনা আরও বেড়েছে কারণ, আইএফসি একদিকে নীতি নির্ধারণে পরামর্শ দিচ্ছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের বন্দর প্রকল্পে নিজেও সম্ভাব্য বিনিয়োগকারী হিসেবে যুক্ত হতে চাচ্ছে—যা স্পষ্টভাবে স্বার্থের সংঘাতের ধারণা তৈরি করে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা।
সিপিএ-র সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা জানান, সিঙ্গাপুরের বন্দর অপারেটর পিএসএ-কে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের বে টার্মিনাল প্রকল্পে অর্থায়ন করতে প্রস্তুত আইএফসি। বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সোহেল এবং এম শাহজাহান প্রকাশ্যে স্বীকার করেছেন যে, পিএসএ ওই প্রকল্পের জন্য আইএফসি থেকে অর্থায়ন পাবে।
শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, "পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের চুক্তিকে ভবিষ্যৎ সব কনসেশনের মানদণ্ড ধরা হচ্ছে। যদি আইএফসি সেখানে বেসরকারি অপারেটরদের অনুকূলে শর্ত নির্ধারণ করে, তাহলে সেই একই শর্ত বে টার্মিনাল ও মাতারবাড়ী প্রকল্পেও প্রয়োগ হবে—যেখানে তাদের নিজস্ব আর্থিক স্বার্থ জড়িত।"
অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনু মুহাম্মদ বলেন, "যখন বিশ্বব্যাংক কোনো বন্দর প্রকল্পে অর্থায়নকারী, তখন আইএফসি-র পক্ষে একই প্রকল্পের নীতিগত কাঠামো তৈরি করা সরাসরি স্বার্থের সংঘাত।"
অর্থনীতিবিদ এম মাসরুর রিয়াজ, যিনি নিজেও এক সময় আইএফসিতে কাজ করেছেন, টিবিএসকে বলেন, "শোনা যাচ্ছে যে বে টার্মিনাল প্রকল্পে আইএফসি সিঙ্গাপুরের পিএসএ-কে অর্থায়ন করতে পারে, যদিও এটি এখনো নিশ্চিত নয়। তবে যদি আইএফসিকে বে টার্মিনালের জন্য কনসেশন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে এটি স্পষ্টতই স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করবে। সিপিএ-র উচিত এই বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা।"
তিনি আরও বলেন, বে টার্মিনালটি 'বিল্ড, ইকুইপ, অপারেট' মডেলে গড়ে তোলা হচ্ছে, যেখানে সিপিএ-র প্রচলিত ট্যারিফ কাঠামো প্রযোজ্য নাও হতে পারে।
আইএফসি'র দ্বৈত ভূমিকা
২০২৪ সালের ২৮ জুন, বিশ্বব্যাংকের নির্বাহী পরিচালকদের বোর্ড গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বে টার্মিনাল নির্মাণে বাংলাদেশকে সহায়তায় ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ অনুমোদন দেয়। এরপর ২০২৫ সালের ২৩ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে ওই অর্থায়ন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
ঋণ অনুমোদনের সময় বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, "এছাড়াও, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের বেসরকারি খাতের শাখা আইএফসি প্রস্তাবিত বেসরকারি খাতনির্ভর টার্মিনালগুলোর একটিতে বিনিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করছে।"
বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র পরিবহন বিশেষজ্ঞ এবং প্রকল্পটির দলনেতা হুয়া তান বলেন, "বে টার্মিনাল প্রকল্পটি দেশের সমুদ্রবন্দর অবকাঠামোকে আধুনিকায়নে সহায়তা করবে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ আরও শক্তিশালী করবে।"
কিন্তু এই বক্তব্যের আড়ালেই রয়েছে একটি সম্ভাব্য স্বার্থসংঘাতের ইঙ্গিত। কারণ, আইএফসি—যে প্রতিষ্ঠান সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বন্দর পরিচালনাকে আর্থিকভাবে আকর্ষণীয় করতে বন্দরের মাশুল উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে— একইসঙ্গে একই ধরনের একটি প্রকল্পে নিজেই বিনিয়োগের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, যদি আইএফসি ওই টার্মিনালগুলোর কোনো একটিতে বিনিয়োগ করে, তাহলে কার্যত তারা এমন একটি প্রকল্পে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করবে, যেখান থেকে নিজেরাই আর্থিক লাভবান হতে পারে—যার ফলে তাদের নিরপেক্ষতা ও ন্যায্যতা নিয়ে গুরতর প্রশ্নের উদ্রেক হবে। এমনকি যদি এই ধারণাও তৈরি হয় যে, আইএফসি টেন্ডার কাঠামো তাদের অর্থায়নকৃত বা পছন্দের কোনো কোম্পানির জন্য সুবিধাজনকভাবে তৈরি করেছে। এতে পুরো প্রক্রিয়া নিয়েই আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে।
এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে আইএফসির আইএফসির কমপেনসেশন মডেল, যেখানে একটি "সাকসেস ফি" বা সফলতা ফি অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা সাধারণত মোট প্রকল্প মূল্যের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ হয়। এটি পিপিপি (সরকার-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর দেওয়া হয়। এই কাঠামো এমন এক ধরনের সূক্ষ্ম চাপ সৃষ্টি করতে পারে, যাতে চুক্তিটি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করা হয়—এমনকি যদি শর্তগুলো সরকার বা স্থানীয় অংশীদারদের জন্য পুরোপুরি অনুকূল না-ও হয়।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, "সরকার যখন বন্দর সেবার ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখন স্পষ্ট হয়ে যায় যে এটি বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দেওয়ার জন্যই করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর ইতিমধ্যেই বিপুল মুনাফায় চলছে—এ অবস্থায় শুল্ক বা মাশুল বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই।"
তিনি আরও বলেন, "অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, যেখানে যেখানে ডিপি ওয়ার্ল্ড বন্দরের দায়িত্ব নিয়েছে, সেখানে তারা প্রথমেই শুল্ক বাড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটরদের বিব্রতকর অবস্থায় না ফেলতে সরকার আগেভাগেই কার্যকর ও লাভজনক টার্মিনালের শুল্ক বাড়িয়েছে।"
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ আরও অভিযোগ করেন, "এই সরকার সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু বন্দরের দক্ষতা বাড়ানোর বদলে আগের স্বৈরাচারী সরকারের মতোই কোনো উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই একের পর এক টার্মিনাল হস্তান্তর করছে।"
ট্যারিফ কাঠামো তৈরিতে আইএফসির ভূমিকা
আইএফসি তার 'লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল পিপিপি প্রজেক্ট ট্রানজাকশন স্ট্রাকচার রিপোর্ট'-এ সতর্ক করেছিল যে বাংলাদেশের কঠোর ও অপরিবর্তনীয় ট্যারিফ নীতি আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটরদের (আইটিও) বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি সেখানে স্পষ্টভাবে সুপারিশ করেছিল "নিশ্চিত ট্যারিফ সংস্কার, যার মধ্যে ট্যারিফ বৃদ্ধির নিশ্চয়তা অন্তর্ভুক্ত থাকবে"—যা প্রকল্পের সফলতার অন্যতম শর্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
এখন সেই পরামর্শ বাস্তবে রূপ পেয়েছে। সরকার বে টার্মিনালের দুটি কনটেইনার বার্থ থেকে শুরু করে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত সব নতুন টার্মিনাল বেসরকারি খাতে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে বাধ্য হয় এক ব্যাপক ট্যারিফ পুনর্বিন্যাসে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাজারকে "আর্থিকভাবে আকর্ষণীয়" করে তুলতেই মূলত হঠাৎ এই বড় পরিসরের ট্যারিফ বৃদ্ধি কার্যকর করা হয়েছে।
এই ট্যারিফ বৃদ্ধির সুবিধাভোগী শুধু ভবিষ্যতের নতুন বিনিয়োগকারীরাই নয়, বরং বর্তমানে পরিচালনাকারীরাও। সৌদি আরবভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল (আরএসজিটিআই) ইতোমধ্যেই পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল পরিচালনা করছে। অন্যদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাতের বন্দর অপারেটর ডিপি ওয়ার্ল্ড খুব শিগগিরই নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি)-এর নিয়ন্ত্রণ পেতে যাচ্ছে, যা এককভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের মোট কনটেইনার পরিবহনের প্রায় ৪০ শতাংশ পরিচালনা করে।
এদিকে ডেনমার্কের শিপিং জায়ান্ট এ.পি. মোলার মায়েরস্ক নজর রেখেছে লালদিয়া টার্মিনাল কনসেশনের দিকে—যার কাঠামো তৈরি করেছে আইএফসি।
ট্যারিফ বাড়ায় যেভাবে লাভবান হবে বিদেশি অপারেটররা
সংশোধিত ট্যারিফ সূচির বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এবং আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর—উভয়েরই আয় এতে বাড়বে। তবে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সেইসব সেবায়, যেগুলো সরাসরি বেসরকারি অপারেটরদের আয়ের উৎস।
বিদেশি অপারেটরদের হ্যান্ডলিং কার্যক্রম—ক্রেন অপারেশন, কনটেইনার লোডিং ও আনলোডিং, স্টোরেজ, রিফার প্লাগ-ইন এবং কনটেইনার চলাচল—এর ট্যারিফ গড়পড়তা ১৪৪ শতাংশ বেড়েছে। তুলনামূলকভাবে, সিপিএ-সংক্রান্ত চার্জ যেমন—পাইলটেজ, নেভিগেশন এবং নদী শুল্ক প্রায় ৭০ শতাংশ বেড়েছে।
মাশুলের খাতগুলো বিস্তারিত পর্যালোচনা করলে এই পার্থক্য আরও স্পষ্ট হয়। যেমন ২০ ফুটের একটি রিফার কনটেইনারের প্লাগ-ইন চার্জ বেড়েছে ৯ ডলার থেকে ২০.৯৬ ডলার, যা ১৩৩ শতাংশ বেড়েছে— এবং পুরোটাই পাবে টার্মিনাল অপারেটর। অন্যদিকে, ১০,০০০ গ্রস রেজিস্টার্ড টনের একটি জাহাজের ন্যূনতম পাইলটেজ ফি বেড়েছে ৩৫৭.৫০ ডলার থেকে ৮০০ ডলার, এই ১২৪ শতাংশ বৃদ্ধির সুবিধাভোগী হয়েছে সিপিএ।
তবে যেহেতু কনটেইনার হ্যান্ডলিং, স্টোরেজ এবং সংশ্লিষ্ট সেবা বন্দরের অধিকাংশ লেনদেনের জন্য দায়ী, তাই এই বিভাগগুলোতে ট্যারিফ বৃদ্ধির কারণে আন্তর্জাতিক অপারেটররা রয়্যালটি পরিশোধের পরেও শেষ পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষের তুলনায় অনেক বেশি আয় উপার্জন করবে।
আইএফসির বক্তব্য
গত ১৯ সেপ্টেম্বর আইএফসি-র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাখতার দিয়োপ এর কাছে একটি ইমেইল করেছে টিবিএস, এরপর আইএফসির একজন মুখপাত্র নিম্নোক্ত জবাব পাঠান—
"আইএফসি তার পরামর্শমূলক সেবার মাধ্যমে সরকারকে পিপিপি প্রকল্পের উন্নয়ন, কাঠামোগত নকশা এবং বাস্তবায়নে সহায়তা করে। আমরা এমন অর্থায়নযোগ্য প্রকল্প নকশায় সহায়তা করি যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বেসরকারি অংশীদারদের আকৃষ্ট করে, যাতে অবকাঠামো স্বচ্ছ ও টেকসইভাবে তৈরি করা যায়।
আমাদের লক্ষ্য হলো সরকারের সক্ষমতা জোরদার করা, যাতে তারা দক্ষতার সঙ্গে অবকাঠামো সরবরাহ করতে পারে, যা স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পিপিপি লেনদেনের জন্য পরামর্শমূলক সেবার বাইরেও, আইএফসি বৈশ্বিকভাবে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন বাজার সৃষ্টি এবং উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বেসরকারি উদ্যোগ সমর্থন করার জন্য বেসরকারি মূলধন আকৃষ্ট করতে কাজ করে।"
আইএফসি বাংলাদেশ সরকারের পরামর্শক হিসেবে পিপিপি কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (সিপিএ) মাধ্যমে কাজ করছে, যার লক্ষ্য বেসরকারি সেক্টরের বিনিয়োগ ও বিশেষজ্ঞ দক্ষতা কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনাকে আরও দক্ষ করা এবং বন্দরের সক্ষমতার সম্প্রসারণ। এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের বিশ্ববাণিজ্যে প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নেওয়া হয়েছে। পিপিপি রূপান্তরের পরামর্শদাতা হিসেবে, আইএফসি তার গ্রাহক সরকারের স্বার্থে কাজ করবে, অপারেটর বা ডেভেলপারদের জন্য নয়।
আইএফসির বিস্তারিত স্বার্থের সংঘাত নীতি ও প্রক্রিয়া রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিশেষায়িত অপারেশনাল কনফ্লিক্ট ফাংশন, যা স্বার্থের সংঘর্ষ ব্যবস্থাপনা ও প্রশমনের জন্য সঠিক পরামর্শ প্রদান করে। কোনক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত দেখা দিলে আইএফসি বিভিন্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা ব্যবহার করতে পারে, যেমন যথাযথ তথ্য প্রকাশ, যেকোনো সংঘর্ষপূর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে টিম পৃথকীকরণ এবং তথ্য শেয়ারের সীমাবদ্ধতা। ফলস্বরূপ, লেনদেন-পরামর্শ সেবার ইউনিট সাধারণত আইএফসির বিনিয়োগ দল থেকে পৃথক থাকে।
আইএফসির পরামর্শ সেবার অংশ হিসেবে লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালের (এলসিটি) জন্য পিপিপি ট্রানজেকশন বাস্তবায়নের সময়, সিপিএ-কে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল ট্যারিফ সংশোধনী বিবেচনা করে দেখতে, যাতে এলসিটির আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। যেহেতু এই টার্মিনালের নকশা, অর্থায়ন, নির্মাণ এবং বেসরকারি অংশীদার দিয়ে পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য উল্লেখযোগ্য মূলধন বিনিয়োগ এবং পরিচালন খরচ রয়েছে।
এলসিটি বার্ষিক সক্ষমতা প্রায় ৮ লাখ টিইইউএস ধরা হয়েছে, যা সিপিএ'র বর্তমান বর্তমান সক্ষমতার প্রায় ২৭ শতাংশ। এটি বাস্তবায়িত হলে, চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হবে, যা সমুদ্রপথে জাহাজের অপেক্ষার সময় কমাবে এবং ব্যবহারকারীদের জন্য ট্রাক টার্নআরাউন্ড সময় কমানোর মাধ্যমে উন্নত সেবা প্রদানের একটি মানদণ্ড স্থাপন করবে।
আইএফসি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে (সিপিএ) সমর্থন দিচ্ছে, ভারসাম্যপূর্ণ ও ব্যাংকেবল ঝুঁকি বন্টনের নকশা তৈরি, কার্যকর বন্দর পরিচালনার মানদণ্ড স্থাপন, এবং সিপিএ'র জন্য একটি ধারাবাহিক ও যথাযথ আর্থিক রিটার্ন নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে।
বাড়ানোর আগে বন্দরের আগের মাশুলও কী চড়া ছিল?
সিপিএ তাদের ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে জানিয়েছে যে, গত চার দশক ধরে এসব রেটের কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, নতুন বৃদ্ধির আগেও তারা উচ্চ চার্জ দিচ্ছিলেন।
ব্যবসায়ীদের প্রধান অভিযোগ হলো, সিপিএ অধিকাংশ ট্যারিফ ডলারে নির্ধারণ করে। ২০২০ সালে যখন ১ ডলারের মান ছিল ৮৫ টাকা, তখন এক টিইইউস কনটেইনারের হ্যান্ডলিং খরচ ছিল ৪৩ ডলার বা ৩,৬৫৫ টাকা। ২০২৪ সালে ডলারের মান বেড়ে ১২৪ টাকা হওয়ায় একই ৪৩ ডলারের চার্জ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫,৩৩২ টাকায়। অর্থাৎ মাত্র চার বছরে ৪৫ শতাংশ বা ১,৬৭৭ টাকা বেড়েছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, নতুন করে বাড়ানোর আগেই এই মুদ্রাজনিত বৃদ্ধি বন্দরের বিভিন্ন ট্যারিফ বা মাশুলকে যথেষ্ট চড়া করে দেয়।
র্যাপিড-এর চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক বলেন, একেবারে ৪০ শতাংশ ট্যারিফ না বাড়িয়ে সিপিএ তা ধাপে ধাপে বাড়াতে পারত। এতে ব্যবসায়ীদের ওপর খরচের চাপ কমতো এবং তারা এরসঙ্গে মানিয়ে চলার সময়ও পেতেন।
তিনি বলেন, "ট্যারিফ টাকায় নির্ধারণ করলে ব্যবসায়ীদের জন্য কিছু স্বস্তি আসত। এতে তারা ডলারের ওঠা-নামা নিয়ে আশঙ্কায় না থেকেই বন্দরের খরচ পূর্বানুমান করতে পারতেন। তাই টাকায় ট্যারিফের হার নির্ধারণ করা একটি বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে।"
প্রতিবেশী দেশগুলোর বন্দরগুলোতে ট্যারিফ বেশি, কিন্তু কার্যকারিতাও চট্টগ্রামের চেয়ে বেশি
চট্টগ্রাম বন্দরের সাম্প্রতিক ট্যারিফ বাড়ানোর ফলে, ২০ ফুটের একটি কনটেইনারের গড় খরচ ৯৭ ডলার থেকে বেড়ে ১৩৩ ডলারে উন্নীত হয়েছে। সর্বোচ্চ বৃদ্ধি এসেছে লোডিং ও আনলোডিং চার্জে, যা কনটেইনার প্রতি ৪৩ ডলার থেকে বেড়ে ৬৮ ডলারে পৌঁছেছে।
এর তুলনায়, সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দর এখনও সার্বিকভাবে বেশি চার্জ নেয়। সিঙ্গাপুরে ২০ ফুটি কনটেইনারের টার্মিনাল হ্যান্ডলিং ফি গড়ে ১৮০-১৯০ ডলার এবং কলম্বোতে ১৫০-২৫০ ডলার। তবে এই বন্দরগুলো দ্রুত জাহাজের টার্নঅ্যারাউন্ড, বিস্তৃত সংযোগ ব্যবস্থা এবং নির্ভরযোগ্য সময়সূচি দেয়—যা প্রাথমিক উচ্চ চার্জের অসুবিধা অনেকটাই পুষিয়ে দেয়।
সমুদ্র বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, "সিঙ্গাপুর ও কলম্বোতে ট্যারিফ বেশি, কিন্তু চট্টগ্রামে কম থাকা সত্ত্বেও প্রকৃত খরচ আরও বেশি হয়ে যায়।"
তিনি ব্যাখ্যা করেন, "সিঙ্গাপুর বন্দর থেকে একটি জাহাজ যাত্রা শুরু করলে, এটি আগমনের সময়ই একটি বার্থ পায়। এক বা দুই দিনের মধ্যে লোড-আনলোড শেষে পরবর্তী গন্তব্যে যেতে পারে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজের বার্থ পেতে দুই থেকে পাঁচ দিন লাগে, তারপরে আনলোড ও লোড করতে লাগে আরও দুই থেকে তিন দিন। অর্থাৎ মোট টার্নঅ্যারাউন্ড সময় ৫–৭ দিন। এই সময়ের জন্য জাহাজকে বন্দরের চার্জ, নদী চার্জ এবং লাইট ডিউস দিতে হয়। এই সময়ে যদি জাহাজের স্থায়ী পরিচালন খরচও যুক্ত করি, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিং খরচ সিঙ্গাপুর ও কলম্বো বন্দরের চেয়ে অনেক বেশি।"
তিনি বলেন, "বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, রপ্তানিকারকরা এখন আরও বেশি খরচের সম্মুখীন হলেও, বন্দরের কার্যকারিতা তেমনভাবে উন্নত হচ্ছে না।"
বন্দরের উচ্চ খরচ ভোক্তার ওপর চাপ বাড়াবে
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই নতুন ট্যারিফে বিদেশি অপারেটরদের আয় বাড়লেও স্থানীয় আমদানি-রপ্তানিকারকরা ব্যবসা পরিচালনার বাড়তি খরচের কারণে হিমশিম খাবে—যার প্রভাব সরাসরি ভোক্তার ওপর পড়বে, যারা এরমধ্যেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছেন।
সিকম শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, "এক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের দরকষাকষির দক্ষতার অভাব স্পষ্ট। আইএফসি-র সুপারিশ মানার আগে সিপিএ-র উচিত ছিল ব্যবসায়ের খরচ বাড়ার দিকটা বিবেচনা করা।"
ট্যারিফ পুনর্মূল্যায়নের আবেদন
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন-এর চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ গত ১৮ সেপ্টেম্বর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে চিঠি দিয়ে নতুন ট্যারিফ কাঠামো পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি দেশের রপ্তানিমুখী অর্থনীতিতে এর সম্ভাব্য প্রভাব এবং বৈশ্বিক ফ্রেইট মার্কেটে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হ্রাসের ব্যাপারেও সতর্ক করেছেন চিঠিতে।
তিনি উল্লেখ করেন, "ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যেই বাড়তি ট্যারিফ দিচ্ছেন মার্কিন ডলারের দর বৃদ্ধির কারণে। শেষবার যখন ট্যারিফ পর্যালোচনা করা হয়, তখন ডলারের বিনিময় হার ছিল ৫০ টাকারও কম। অথচ বর্তমানে ডলারের দাম বেড়ে ১২০ টাকায় পৌঁছেছে।"
আরিফের আশঙ্কা, এই ট্যারিফ কাঠামো রপ্তানিমুখী অর্থনীতির প্রতিযোগিতা ক্ষমতা ক্ষুণ্ণ করবে এবং বিশ্ববাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল করবে।