বাংলাদেশ–ভারত উত্তেজনায় যেভাবে টালমাটাল হয়ে উঠেছে ভারতীয় শাড়ির বাজার

বেনারস শহরের সরু, ঘিঞ্জি গলিতে মন্দিরের ঘণ্টার সঙ্গে আজানের সুর মিলেমিশে একাকার। এর সঙ্গে কয়েক দশক ধরে মোহাম্মদ আহমদ আনসারির কানে অবিরাম বেজে চলেছে তাঁতের খটখট শব্দ।
ভারতের আধ্যাত্মিক রাজধানী আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী এলাকা বেনারসেই কেটেছে তার ৫৫ বছরের জীবন। ঐতিহ্যবাহী বেনারসি শাড়ি বুনেই তার দিনযাপন। কিন্তু সেই চেনা শব্দ এখন অনেকটাই স্তিমিত।
আনসারির মতো হাজারো তাঁতির কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক টানাপোড়েন। বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিলে দুই দেশের সম্পর্কে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয়। এর জের ধরে বাণিজ্যিক সম্পর্কেও ফাটল ধরে।
গত এপ্রিলে বাংলাদেশ ভারত থেকে সুতা ও চালসহ কিছু পণ্য আমদানি সীমিত করে। পাল্টা জবাবে ভারতও স্থল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী আমদানি নিষিদ্ধ করে। যদিও বাংলাদেশ এখনও ভারতে শাড়ি পাঠাতে পারে, তবে তাদের এখন তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ সমুদ্রপথ ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
এর সরাসরি প্রভাব এসে পড়েছে বারানসির বিশ্বখ্যাত বেনারসি শাড়ির বাজারে।

সংকটে বেনারসির ঐতিহ্য
একেকটি বেনারসি শাড়ি যেন একেকটি শিল্পকর্ম। সূক্ষ্ম রেশম আর সোনা-রুপার জরির কাজে বোনা একটি শাড়ি তৈরি হতে ছয় মাসও লেগে যায়। দামও লাখ রুপি ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশে উৎসব-পার্বণে এই শাড়ির বিপুল চাহিদা।
তাঁতশিল্পী আনসারি বলেন, 'বাংলাদেশে আমাদের ব্যবসার বড় একটি অংশ ছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যবসা ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেছে।'
এই ধাক্কাটি এসেছে এমন এক সময়ে, যখন বারানসির তাঁতশিল্প আগে থেকেই ধুঁকছিল। সরকারের নোট বাতিল, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি, করোনা মহামারি এবং গুজরাটের সুরাটের মতো জায়গায় যন্ত্রচালিত তাঁতের সস্তা শাড়ির সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা—সব মিলিয়ে এই শিল্প ছিল বিপর্যস্ত; নতুন এই সংকট যেন 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা'।
গত কয়েক বছরে তাঁতির সংখ্যা অর্ধেক হয়ে প্রায় দুই লাখে ঠেকেছে। টিকে থাকতে না পেরে অনেকে শহর ছেড়েছেন, কেউবা জীবিকা নির্বাহের জন্য রিকশা চালানোর মতো কাজ বেছে নিয়েছেন। বেনারসের পাইকারি ব্যবসায়ী পবন যাদব বলেন, 'বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১০ হাজার শাড়ি পাঠাতাম, এখন সব বন্ধ। সেখানে আমার প্রায় ১৫ লাখ রুপি আটকে আছে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় সে টাকা ফেরত পাওয়ার আশা দেখি না।'
কৃষির পর ভারতের বস্ত্রখাতই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থানের উৎস। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, এই খাতে ৩৫ লাখেরও বেশি মানুষ কাজ করেন। এর মধ্যে শুধু শাড়ি শিল্পের বাজারমূল্য প্রায় ৮০ হাজার কোটি রুপি (প্রায় ৯.০১ বিলিয়ন ডলার), যার মধ্যে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার আসে রপ্তানি থেকে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে টানা তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত করা বেনারসের তাঁতি ও ব্যবসায়ীরা অবশ্য এখনও তার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তাদের বিশ্বাস, মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সমস্যাটির একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করবেন।
এর আগে, ২০১৫ সালে মোদি সরকার ৭ আগস্টকে 'জাতীয় তাঁত দিবস' হিসেবে ঘোষণা করে এবং দেশীয় পণ্যের প্রচারের মাধ্যমে তাঁতিদের জীবনে পরিবর্তন আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তাদের অভিযোগ, সেগুলোর কোনো সুফল তারা পাননি।
'সেভ দ্য লুম' নামক একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা রমেশ মেনন বলেন, 'ভারতের তাঁতশিল্প অনন্য। কিন্তু আয়ের নিশ্চয়তা না থাকায় কারিগরেরা পেশা ছাড়ছেন। এখন একজন তরুণ তাঁতি খুঁজে পাওয়াও কঠিন।'

পশ্চিমবঙ্গে উল্টো চিত্র
তবে এই নিষেধাজ্ঞা যেন বেনারসের জন্য নিয়ে এসেছে সর্বনাশ, আর পশ্চিমবঙ্গের জন্য পৌষ মাস। বেনারসের এই হাহাকারের ঠিক উল্টো চিত্র বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে। ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা পশ্চিমবঙ্গের সুতি শাড়ির বাজারকে নতুন করে প্রাণ দিয়েছে। এতদিন ঢাকার শাড়ির দাপটে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুর, হুগলি, মুর্শিদাবাদের তাঁতিরা কোণঠাসা ছিলেন। এখন পরিস্থিতি বদলেছে।
শান্তিপুরের প্রবীণ শাড়ি ব্যবসায়ী তারক নাথ দাসের মুখে এখন চওড়া হাসি। গত দুর্গাপূজায় তার ব্যবসা বেড়েছে ২৫ শতাংশ। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের শাড়ি আমাদের বাজারের প্রায় ৩০ শতাংশ দখল করেছিল। এখন সেই বাজার আমরা ফিরে পাচ্ছি। প্রচুর অর্ডার আসছে।'
পূর্ব ভারতের শাড়ি ব্যবসার কেন্দ্র শান্তিপুরে প্রায় এক লাখের বেশি তাঁতি ও ব্যবসায়ী রয়েছেন। তাদেরই একজন সঞ্জয় কর্মকার। তিনিও এই নিষেধাজ্ঞায় খুশি। তার মতে, 'বাংলাদেশের শাড়ির উন্নত মান ও আকর্ষণীয় প্যাকেজিংয়ের কারণে ক্রেতারা সেদিকেই ঝুঁকতেন।'
ফ্যাশন ডিজাইনার শান্তনু গুহঠাকুরতা মনে করেন, এই নিষেধাজ্ঞাটি এসেছে একেবারে সঠিক সময়ে। উৎসবের মৌসুমের ঠিক আগে আসায় পশ্চিমবঙ্গের তাঁতশিল্প ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে।