পরিবেশ উদ্বেগের মধ্যেই আধুনিক পর্যটন গড়তে চর বাকলিয়ায় ২০০ একর জমি চায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চর বাকলিয়ায় আধুনিক পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে ২০০ একর অকৃষি খাসজমি প্রতীকী মূল্যে দীর্ঘমেয়াদে বন্দোবস্ত চেয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)।
এর আগে, একই স্থানে ৩৫ একর জমিতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রকল্প নিতে চেয়েছিল চসিক। তবে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের আশঙ্কায় পরিবেশবাদী ও নাগরিক সমাজের আপত্তির কারণে গত বছর সরকার সেই প্রকল্প বাতিল করা হয়। নতুন করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেও পরিবেশবাদীরা কংক্রিট স্থাপনার বিপক্ষে মত দিয়েছেন।
চলতি বছরের ১৪ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক চিঠিতে সিটি মেয়র শাহাদাত হোসেন চর বাকলিয়াকে ঘিরে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা এবং 'ওয়ান সিটি টু টাউন' বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে ভূমি বরাদ্দ চান।
চিঠিতে বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুর দেড় কিলোমিটার দূরে বোয়ালখালী উপজেলার চর বাকলিয়া মৌজার ৩২৩ থেকে ৫৪৪ দাগভুক্ত ২০০ একর খাসজমি চসিককে বন্দোবস্ত দেওয়া প্রয়োজন। এতে পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হলে সিটি করপোরেশন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে এবং দেশি-বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট হবে। পাশাপাশি নগরীর জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বিনোদনের সুযোগও তৈরি হবে।
চসিকের সচিব মোহাম্মদ আশরাফুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগে মানালির মতো থিম পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নেরও উদ্যোগ আছে। এ লক্ষ্যে প্রস্তাব দিয়ে ভূমি বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।"
২০২৩ সালের শেষ দিকে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চর বাকলিয়ায় প্রতীকী মূল্যে ৩৫ একর জমি বরাদ্দ চেয়েছিল সিটি করপোরেশন (চসিক)। ওই জমিতে চীনা প্রতিষ্ঠান 'সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভি'র বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ও সম্মতি দিয়েছিল।
কিন্তু ২০২৪ সালের শুরুতে পরিবেশকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এর বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামেন। তাদের আশঙ্কা ছিল, নদীর পানি দূষিত হবে এবং জীববৈচিত্র্যসহ পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একই বছরের অক্টোবর মাসে প্রকল্পটি বাতিল হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ও শেষ পর্যন্ত জমি বরাদ্দ দেয়নি।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ফরিদা খানম টিবিএসকে বলেন, "সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রথমে আমার কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। আমি তা গ্রহণ না করে ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছিলাম। এখনও আমাদের কাছে মতামত চাওয়া হয়নি।"
"মন্ত্রণালয় চাইলে পরিবেশ ছাড়পত্রসহ প্রস্তাবটি পর্যালোচনা করে মতামত দেওয়া হবে। যেহেতু প্রস্তাব সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি, তাই এখনই মতামত দেওয়া যাচ্ছে না," যোগ করেন তিনি।
কর্ণফুলী নদীতে চর জাগা শুরু হয় প্রায় একশো বছর আগে, কালুরঘাট এলাকায় প্রথম কর্ণফুলী সেতু নির্মাণের পর। বর্তমানে শাহ আমানত সেতু ও কালুরঘাট সেতুর মাঝামাঝি স্থানে প্রায় ২০০ একর আয়তনের চর বাকলিয়া অবস্থিত। এর মধ্যে ১১৬ একর সরকারি দখলে রয়েছে এবং ১ নম্বর খাস খতিয়ানভুক্ত।
চরের বিস্তার কর্ণফুলীর দক্ষিণ তীরের পটিয়ার লাখেরা থেকে বোয়ালখালীর চর খিজিরপুর পর্যন্ত। আকৃতিতে এটি অনেকটা লেজওয়ালা ঘুড়ির মতো। যেখানে চর জেগেছে, সেখানে নদীর প্রস্থ আশপাশের তুলনায় অর্ধেক হয়ে গেছে। মাঝের অংশে ঘন গাছপালা থাকলেও তীরের পাশে তুলনামূলক কম।
চর বাকলিয়ার জংলা বনে গড়ে উঠেছে হাজারো পাখির আবাস। এখানে দেখা যায় বিপন্ন প্রজাতির কালো মাথা কাস্তেচরা, লাল লতিকা হট্টিটি, সাদা বক, গো-বক, মাছরাঙাসহ নানা প্রজাতির পাখি। মৌসুমে অতিথি পাখিও আসে। প্রতিদিন স্থানীয়রা শত শত মহিষ চড়াতে নিয়ে যান এই চরে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকো'র ২০২২ সালের এক গবেষণায় চর বাকলিয়ায় ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ সনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ৬৪টি বৃক্ষ, ২০টি বিরুৎ, ৫৭টি গুল্ম, ১২টি লতানো উদ্ভিদ এবং ২টি পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ। এসবের মধ্যে ১১৩টি ঔষধি গাছ। চরে পাওয়া যায় পাহাড়ি শিমুল, বেগুনি হুরহুরি, প্রাজাসেন্ট্রা, হরগোজা, ভূঁইউকড়া, ঝুমকো লতা, আকন্দ, স্বর্ণলতা, ঘাগড়া, শিয়ালকাঁটা, শিরিষসহ নানা প্রজাতির গাছপালা। এছাড়া আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেলসহ দেশীয় ফলজ গাছও রয়েছে।
চরে কংক্রিট স্থাপনা নির্মাণের বিরোধিতা করে চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক আলিউর রহমান টিবিএসকে বলেন, "২০১৯ সালে হাইকোর্ট নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮ (ক) অনুসারে পরিবেশ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণি সংরক্ষণে রাষ্ট্রের বাধ্যবাধকতা আছে। ইকো-ট্যুরিজম হলে আপত্তি নেই, কিন্তু কংক্রিট স্থাপনা বা হোটেল-মোটেল হলে আমরা বিরোধিতা করব।"
আলিউর রহমান আরও বলেন, "কর্ণফুলী নদী ও চর বাকলিয়া মিলিয়ে ৫২৮ প্রজাতির উদ্ভিদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮১ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে এবং ৩৩০ প্রজাতি এখনও টিকে আছে। এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। তাই কোনো পরিকল্পনা গ্রহণের আগে পুরো চর নিয়ে পূর্ণাঙ্গ সমীক্ষা করা দরকার।"
"সেখানে দেশীয় গাছের বাগান করা যেতে পারে। পাখিরা দেশীয় গাছপালা পছন্দ করে। কংক্রিট স্থাপনা না করে পরিবেশের ক্ষতি ছাড়াই ইকো-ট্যুরিজম চালু করা যেতে পারে। দিনের নির্দিষ্ট সময়ে পর্যটকদের জন্য চর উন্মুক্ত রাখা যেতে পারে," বলেন তিনি।
কর্ণফুলী রক্ষায় জনগণের মঞ্চের আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, "পর্যটন হলে পাখির অভয়ারণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তবে পর্যটন কেন্দ্র হলে মাঝিসহ স্থানীয়দের আয় বাড়বে। এজন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগে অংশীজনদের মতামত নেওয়া উচিত।"