চট্টগ্রামের বিপ্লব উদ্যানে ফের বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের উদ্যোগ, আপত্তি নাগরিক সমাজ-উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের

চট্টগ্রাম নগরীর ২ নম্বর গেটের বিপ্লব উদ্যানকে 'উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ' নামে আবারও বাণিজ্যিক স্থাপনার জন্য ইজারা দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নূর হাফিজ প্রপার্টিজের সঙ্গে ২৫ বছরের জন্য চুক্তি করেছে সংস্থাটি।
চুক্তি অনুযায়ী, উদ্যানে বিদ্যমান একতলা ভবন বর্ধিত করে চারতলা পর্যন্ত নির্মাণ করা যাবে। সুযোগ থাকবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোরও।
তবে সবুজ উদ্যানে নতুন করে কংক্রিট স্থাপনার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের দাবি, এর ফলে শহরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সবুজ খোলা জায়গা হারিয়ে যাবে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) জানিয়েছে, সবুজ উদ্যানে নতুন স্থাপনা তৈরির কোনো সুযোগ নেই।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নূর হাফিজ প্রপার্টিজের সঙ্গে চুক্তি করে সংস্থাটি। চুক্তি অনুযায়ী, উদ্যানে বিদ্যমান একতলা ভবনকে চারতলা পর্যন্ত বাড়ানোর সুযোগ থাকছে। দ্বিতীয় তলায় আধুনিক সবুজবান্ধব আরবান লাউঞ্জ, তৃতীয় তলায় ইনডোর গেমসের জন্য কফিশপ, আরেক অংশে খোলা আকাশের নিচে বসার স্থান ও কফিশপ এবং চতুর্থ তলায় চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক প্রদর্শনী কেন্দ্র করার সুযোগ থাকবে।
এছাড়া উদ্যানে থাকা ২১টি দোকান ও দুটি শৌচাগার নতুন প্রতিষ্ঠানের হাতে যাবে। দোকানমালিকদের নতুন করে চুক্তি করতে হবে তাদের সঙ্গে। বিনিয়োগের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্প এলাকায় দেশি-বিদেশি কোম্পানির বাণিজ্যিক প্রচারের জন্য ডিজিটাল স্ক্রিন, এটিএম বুথ ও কিয়স্ক স্থাপন করতে পারবে। খোলা মাঠে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার আদলে অবকাঠামো, চারপাশে হাঁটাপথ, দেড় হাজার বর্গফুটের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘর এবং ডিজিটাল বিলবোর্ড বসানোর সুযোগও থাকবে।
চসিকের তথ্যমতে, ১৯৭৯ সালে এক একর জমিতে বিপ্লব উদ্যান গড়ে তোলা হয়। গত সাত বছরে তিন মেয়রের আমলে সৌন্দর্যবর্ধন ও উন্নয়নের নামে তিনটি চুক্তি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সবুজ উদ্যানে একের পর এক বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে উঠেছে।
এর আগে, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আদালত বিপ্লব উদ্যানে নতুন অবকাঠামো নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আদালতের রায়ে মেয়রের দায়িত্ব পান ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি গত বছরের ৭ নভেম্বর উদ্যান পরিদর্শনে গিয়ে ঘোষণা দেন—এখানে কোনো নতুন স্থাপনা তৈরি হবে না। তার আগে রেজাউল করিম চৌধুরীর আমলে নির্মাণাধীন কাঠামো ভাঙার নির্দেশ দেন মেয়র, যা পরে ভেঙে ফেলা হয়।
গত ১১ নভেম্বর সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় আগের মেয়াদের চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। সভায় মেয়র শাহাদাত জানান, বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক স্থাপনার চেয়ে সবুজায়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি পুরোনো চুক্তি বাতিলও করে চসিক। তবে মাত্র ছয় মাস পরই উদ্যানে নতুন বাণিজ্যিক স্থাপনার জন্য চুক্তি করা হয়।
চুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা এসএম সরওয়ার কামাল।
যদিও তিনি গত ২৩ জুন বাজেট অধিবেশনে দাবি করেছিলেন, "বিপ্লব উদ্যানে নতুন করে কোনো দোকান নির্মাণ করা হবে না। আগে উদ্যানে থাকা দোকান থেকে সিটি করপোরেশন এক লাখ টাকা পেত, নতুন চুক্তির ফলে তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকা।"
নাগরিক সমাজের ক্ষোভ
গত বছরের ৩ অক্টোবর চসিক আয়োজিত গণশুনানিতে বিপ্লব উদ্যানে নতুন স্থাপনা না করার পক্ষে জোরালো মত দিয়েছিলেন বক্তারা। মেয়রও একই ঘোষণা দেন। এরপরও নতুন চুক্তি করায় নগর পরিকল্পনাবিদ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সমালোচনা করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা ও সিভিল সোসাইটি প্রতিনিধিরা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) চিঠি দিয়ে অনুমোদন না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।
চুয়েটের একদল গবেষকের জরিপে বলা হয়েছে, বিপ্লব উদ্যান কার্যত কংক্রিটের জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এখানে ৫৫ শতাংশ এলাকা কংক্রিটে ঢেকে গেছে। অথচ ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী কোনো উদ্যানে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের বেশি কংক্রিট অবকাঠামো থাকার অনুমতি নেই। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এ হার ২ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
গত ১৭ জুলাই ফোরাম ফর প্ল্যান্ড চট্টগ্রাম-এর পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে বিপ্লব উদ্যানে বহুতল ভবন নির্মাণ পরিকল্পনা বন্ধ ও বাতিলের দাবি জানানো হয়। সংগঠনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সিডিএর মাস্টারপ্ল্যানে 'উদ্যান' হিসেবে চিহ্নিত এ এলাকায় বাণিজ্যিক বহুতল ভবন নির্মাণ অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং বিদ্যমান আইনের পরিপন্থী।
সিডিএর বোর্ড সদস্য ও পরিকল্পিত উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জারিনা হোসেন বলেন, "এটুকু জায়গায় (বিপ্লব উদ্যান) কেন সিটি করপোরেশনকে হাত দিতে হবে? গত বছরও আমরা সভা করেছি। তখনও বলা হয়েছিল এখানে নতুন স্থাপনা হবে না। এর আগেও সবুজ উদ্যান ধ্বংস করা হয়েছে। উদ্যানে স্থাপনার সুযোগ নেই—এ কথা আমরা সিডিএকে জানিয়েছি। বোর্ড সদস্য হিসেবেও আমি এ বিষয়ে ভূমিকা রাখব।"
সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম বলেন, "উদ্যানে স্থাপনার কোনো সুযোগ নেই। এ বিষয়ে কোনো আবেদন এসেছে কি না আমি নিশ্চিত নই। তবে আইন অনুযায়ী উদ্যানে কোনো স্থাপনা অনুমোদনের সুযোগ নেই।"
পরিবেশবাদীদের চিঠি
বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল'ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেলা) সম্প্রতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র, জেলা প্রশাসকসহ ৮ কর্মকর্তার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে বিপ্লব উদ্যান ইজারা না দেওয়ার পাশাপাশি উদ্যানে সৌন্দর্যবর্ধনের নামে করা চুক্তি বাতিলের দাবি জানানো হয়।
বেলারের চিঠিতে আরও বলা হয়, উদ্যানে বিদ্যমান সব স্থাপনা সরিয়ে জনসাধারণের প্রবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং উদ্যানের যথাযথ সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, "চিঠির কথা শুনেছি, তবে হাতে পাইনি।"