চট্টগ্রাম-৩: হেভিওয়েট মোস্তফা কামালে নির্ভার বিএনপি, নতুন মুখ নিয়ে চ্যালেঞ্জে জামায়াত
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী থাকায় গত ৩ নভেম্বর দলটির প্রথম দফায় ঘোষিত ২৩৭টি আসনের মধ্যে এই আসনটির নাম ছিল না। মূলত দলীয় অন্তঃকোন্দলের কারণেই শুরুতে তা ঘোষণা করা হয়নি। প্রায় একমাস পর গত ৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় দফার ঘোষণায় এই আসনে সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশাকে প্রার্থী করা হয়। অভিজ্ঞ ও প্রবীণ এই নেতাকে প্রার্থী করায় অনেকটা নির্ভার হয়েছে দলটি।
বিপরীতে সন্দ্বীপ আসনে সংসদ সদস্য প্রার্থী হিসেবে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা জামায়াতের আমীর আলাউদ্দিন শিকদারকে ঘোষণা করেছে জামায়াতে ইসলামী। ফলে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থীর বিপরীতে নতুন মুখ নিয়ে ভোটের মাঠে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে দলটিকে।
দেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে অবস্থিত সন্দ্বীপ উপজেলা ৭৬২.৪২ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত। এখানে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষের বসবাস। উপজেলাটিতে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭২ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ২৫ হাজার ১৭ জন এবং পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৩২ হাজার ৫৫৩ জন।
হেভিওয়েট প্রার্থী দিয়ে নির্ভার বিএনপি
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে বিএনপির প্রার্থী সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তফা কামাল পাশা দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। প্রবীণ এই রাজনীতিবিদ এই আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে শুরু করে উপজেলা চেয়ারম্যান হয়ে জাতীয় সংসদে গিয়েছিলেন তিনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দিলেও গণঅভ্যুত্থানের পর তিনি আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন এবং প্রভাবক নেতাদের সঙ্গে দেখা করেছেন।
মোস্তফা কামাল ছাড়াও এই আসনে আরও তিনজন মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন। তারা হলেন, উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক বেলায়েত হোসেন এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির দুই সদস্য মিজানুর রহমান মিল্টন ও তরিকুল আলম তেনজিং। তবে প্রার্থী ঘোষণার পর বেলায়েত ও তরিকুল সরাসরি মোস্তফা কামালের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং মিল্টন ফোনে কথা বলেছেন। ফলে হেভিওয়েট প্রার্থী হিসেবে দলীয় বিরোধের ঝামেলা থেকে এখন অনেকটাই মুক্ত মোস্তফা কামাল।
এ বিষয়ে বিএনপির প্রার্থী মোস্তফা কামাল পাশা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, '২০১৮ সালে আমার শারিরীক অসুস্থতা ছিল। হার্টবিট ড্রপ করত, তখন চিকিৎসকরা ধরতে পারছিলেন না। পরে সমস্যা ধরে পেসমেকার স্থাপন করা হয়। আর সন্দ্বীপের মানুষ আমাকে নির্বাচনে নামতে বাধ্য করেছেন। তারেক রহমান লন্ডন থেকে লোক পাঠিয়েছেন, ঘোষণার পর যেন আমি নির্বাচন বা রাজনীতি করব না সেটি না বলি। মনোনয়ন পাওয়ার পর অন্য প্রত্যাশীরা আমার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন।'
মাঠে সাড়া পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'সকাল-বিকাল নেতাকর্মীরা দেখা করতে আসছেন। এখন তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেই দিন পার করছি।' জামায়াত প্রসঙ্গ টেনে তিনি মন্তব্য করেন, 'শেষ পর্যন্ত জামায়াতের প্রার্থী হাত পাখার প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নেমে যেতে পারেন বলে আমি মনে করি। কারণ একজন জেলা আমীর নির্বাচনে হারতে চাইবেন না।'
অন্যদিকে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক বেলায়েত হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'দল ওনাকে (মোস্তফা কামাল) মনোনয়ন দিয়েছে। আমরা সবাই ধানের শীষের নির্বাচন করব। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। মোস্তফা কামাল সাহেবের বয়স হয়েছে, তিনি এখনও নির্বাচনী গণসংযোগ শুরু করেননি। ১৬ ডিসেম্বর নির্বাচন পরিচালনার বিষয়ে সভা ডাকা হয়েছে। সন্দ্বীপ বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা।'
নতুন প্রার্থী নিয়ে চ্যালেঞ্জে জামায়াত
সন্দ্বীপ আসনে জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আমীর আলাউদ্দিন শিকদার। দলটির প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার পর গত ১০ মাস ধরে নির্বাচনী এলাকায় নিয়মিত প্রচার-প্রচারণা ও নানা সামাজিক কার্যক্রমে অংশ নিতে দেখা গেছে তাকে। মূলত বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে অন্তঃকোন্দলের সুযোগ নিতে চেয়েছিল জামায়াত। তাদের ধারণা ছিল, সাবেক এমপির শারীরিক অবস্থা ও বয়স বিবেচনায় মোস্তফা কামালকে প্রার্থী না করা হলে বিরোধ বাড়ত এবং অপর তিন মনোনয়ন প্রত্যাশীর কেউ কাউকে ছাড় দিতেন না। ওই সুযোগটি কাজে লাগানোর সম্ভাবনা ছিল জামায়াতের। কিন্তু প্রবীণ নেতা মোস্তফা কামাল প্রার্থী হওয়ায় বিএনপির অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা তাকে সহজে মেনে নিয়েছেন। ফলে এখন জামায়াতের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ এর আগে জামায়াতের এই প্রার্থী কোনো নির্বাচনে অংশ নেননি।
তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্মের নানা প্রত্যাশা রয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতের প্রার্থী আলাউদ্দিন শিকদার টিবিএসকে বলেন, 'নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা যাচ্ছি, সাড়া পাচ্ছি। পুরাতন পরিস্থিতির বাইরে গিয়ে কোন প্রার্থী কী করবেন, মানুষ তা মূল্যায়ন করছেন। একসময় মোস্তফা কামাল সাহেবের জন্য আমরাও নির্বাচন করেছিলাম। এখন পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। ফলে আমি কোনো চাপ অনুভব করছি না।'
এই আসনে বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হয়েছেন আমেরিকার ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেন এবং গণঅধিকার পরিষদের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন নাসরিন আক্তার।
সন্দ্বীপের ভোটের পরিসংখ্যান
সন্দ্বীপের ভোটের পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের জুনের নির্বাচনে এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মোস্তফা কামাল পাশা নির্বাচিত হন। অর্থাৎ একসময় আওয়ামী লীগের দখলে থাকা আসনটি বিএনপি অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হয়। ২০০৮ সালে সারা দেশে বিএনপি-জামায়াত জোট যে অল্প কয়েকটি আসন পেয়েছিল, এটি তার মধ্যে অন্যতম ছিল।
পরবর্তীতে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাফিজুর রহমানের ছেলে মাহফুজুর রহমান মিতা এখান থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন।
