যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষিপণ্য, জ্বালানি আমদানি বাড়ায় আরও শুল্ক ছাড়ের আশা করছে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, গম, সয়াবিন ও জ্বালানি আমদানি বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ, এমতাবস্থায় সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ মার্কিন পাল্টা শুল্ক কমানোর। এই ছাড় পাওয়া গেলে হলে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগিতায় নতুন সুযোগ তৈরি হবে এবং বাণিজ্য ঘাটতির ভারসাম্যও বদলে যেতে পারে।
গতকাল রোববার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর (ইউএসটিআর) -এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকের পর বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, যুক্তরাষ্ট্র আশ্বাস দিয়েছে—বাংলাদেশ যদি তাদের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি আরও কমাতে পারে, তবে বর্তমানে আরোপিত ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক হ্রাস করা হতে পারে।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি কমে আসায় যুক্তরাষ্ট্র সন্তোষ প্রকাশ করেছে। ''সুনির্দিষ্ট কোনও শুল্কহার আরোপ করার বিষয়ে কোন আলোচনা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি নিম্নতর হলে শুল্কহার কমানোর বিষয়ে আমরা প্রস্তাব করেছি। তারা আশ্বাস দিয়েছে বলেছেন, বাণিজ্য ঘাটতি কমলে শুল্কহার কমাবে। চলতি মাসের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে।''
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ তাদের শুল্কহার আরও কমানোর আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য আলোচনা নতুন করে শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ যাতে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারে, সেজন্য বাংলাদেশও শুল্কহার আরও কমাতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, ''বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্কহার কমতে পারে। এটি কমে ১৮ শতাংশ হতে পারে বলে ধারণা করছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর ইউএসটিআর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।''
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী ইউএসটিআর ব্রেন্ডেন লিঞ্চের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে তিন দিনের সফরে ঢাকায় এসেছে প্রতিনিধিদলটি। রোববারের বৈঠকে বাণিজ্য উপদেষ্টা ছাড়াও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ও বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
আজ সোমবার বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এর সঙ্গে বৈঠক করবে ইউএসটিআর প্রতিনিধিদল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়ানোর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্কহার ২০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ বা তারও কম নির্ধারণের প্রস্তাব করা হবে বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি মাহমুদ হাসান খান।
তিনি বলেন, "শুল্কহার আরও কমানোর জন্য আমাদের পক্ষ থেকে তুলাসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি বাড়াব। যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত অনুযায়ী, লেবার রাইটস ও লেবার ওয়েলফেয়ারে (শ্রমিকদের অধিকার ও কল্যাণে) গুরুত্ব দেব।"
কমছে বাণিজ্য ঘাটতি
বৈঠক পরবর্তী ব্রিফিংয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে যেসব পণ্য কেনার কমিটমেন্ট করেছে, সেগুলোর অগ্রগতি নিয়ে সভায় আলোচনা হয়েছে। এছাড়া, বাণিজ্য সংক্রান্ত একটি জয়েন্ট ডিক্লারেশন (যৌথ ঘোষণা) নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
তিনি বলেন, ইউএসটিআরের সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় অগ্রগতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি কমছে। "কৃষিপণ্য ও জ্বালানি আমদানি বাড়িয়ে এই ঘাটতি আরও কমানো হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কমদামে এসব পণ্য আমদানি করছে বাংলাদেশ। চীন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশ এ সুবিধা পাচ্ছে"- বলেও উল্লেখ করেন শেখ বশিরউদ্দীন।
তিনি আরও বলেন, ''আমাদের অগ্রগতি সন্তোষজনক এবং পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত তুলা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির মাধ্যমে ঘাটতি আরও কমাতে পারলে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত শুল্ক আরও কমবে।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার। আমরা চাইলে এটি অনেকটা কমানো সম্ভব। গতবছর যেখানে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানি হয়েছে, এবার (চলতি অর্থবছরের) দুই মাসেই ২৭৬ মিলিয়ন ডলারের তুলা আমদানি করা হয়েছে।
রাশিয়া বাংলাদেশের কাছে ২৭৬ মিলিয়ন ডলার দরে গম বিক্রির প্রস্তাব দিলেও – যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০২ মিলিয়ন ডলার দরে গম কেনার চুক্তি করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, "যুক্তরাষ্ট্রের গমের প্রোটিন রাশিয়ার গমের তুলনায় ১০-১৫ শতাংশ বেশি। তাই বেশি দামে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কম কেনা হচ্ছে এটি বলা যৌক্তিক নয়।"
"বেসরকারিখাত ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১০ লাখ টন সয়াবিন আমদানি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা সয়াবিনের দাম একটু বেশি হলেও— তার মান এবং তেল উৎপাদনের পরিমাণ বেশি। তাই বেশি দামে আমদানি করলেও প্রফিট বেশি হচ্ছে"- জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে কোন বছর কি পরিমাণ বোয়িং উড়োজাহাজ আমদানি করা হবে, সে বিষয়ে সরকার কোনও পরিকল্পনা দিয়েছে কি-না এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, আমরা কোনো পরিকল্পনা দেইনি। ২০৩২ সাল পর্যন্ত বোয়িং ও এয়ারবাস কোনো উড়োজাহাজ সরবরাহ করতে পারবে না। বোয়িংয়ের উড়োজাহাজ আমদানির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়ছে উল্লেখ করে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, দেশের মোট চাহিদার ২ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। বাকি ৯৮ শতাংশ তুলা আমদানি করে বাংলাদেশ। বেসরকারিখাত যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানি বাড়াচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন ও সয়া মিল আমদানি ইতোমধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২৪ সালে এটি ছিল ৩৪৮.৯ মিলিয়ন ডলার।
জুলাই মাসে সরকারের ক্রয় কমিটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৬০০ কোটি টাকার এলএনজি আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করে। একই সময় খাদ্য মন্ত্রণালয় দেড় লাখ টন গম আমদানির চুক্তি করে।
এ ছাড়া, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি হেলেনিক ড্রাই বাল্ক ভেঞ্চারস এলএলসি থেকে ৭৬.৬৯৮ মিলিয়ন ডলার বা ৯৩৫ কোটি টাকায় দুটি বাল্ক ক্যারিয়ার জাহাজ কেনার অনুমোদন দেয়।
শুল্ক কমিয়ে ১৫ শতাংশে নামানোর লক্ষ্য
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) এর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে বলেন, বাংলাদেশের ওপর আরোপিত মার্কিন শুল্কহার ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে বাণিজ্য উপদেষ্টা চেষ্টা করছেন বলে ইতোপূর্বে জানিয়েছেন। এটি হলে মার্কিন কাঁচামাল আমদানি আরও বাড়বে। তবে আমাদের প্রত্যাশা হলো, যুক্তরাষ্ট্রের তুলায় উৎপাদিত তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া।
তিনি বলেন, ''এ সুবিধা নিশ্চিত হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ তুলা বাংলাদেশ আমদানি করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিও বাড়বে, যা উভয় দেশের জন্যই উইন উইন সিচুয়েশন হবে।"
এর আগে বাণিজ্য উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেছেন, বাংলাদেশের ওপর আরোপিত রেসিপ্রোকাল শুল্কহার ১৫ শতাংশ নির্ধারণের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস প্রায় দেড় মাস ধরে এ আলোচনা করার পর তিনদিনের সফরে ঢাকা এসেছে ইউএসটিআর প্রতিনিধিদল। আজ সোমবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে এবং আগামীকাল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে তাদের।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, গত ৭ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্কের হার কমিয়ে ২০ শতাংশ কার্যকর করেছে। তবে দেশটির সঙ্গে এখনও কোনো চুক্তি হয়নি। পাল্টা শুল্ক অন্তত ১৫ শতাংশে নামিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে চুক্তি করতে চায় ঢাকা। এ কারণে আলোচনার জন্য ইউএসটিআরের কাছে সময় চেয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এতে সাড়া দিয়ে ঢাকা সফরে এসেছে সহকারী ইউএসটিআর ব্রেন্ডেন লিঞ্চের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল।
কর্মকর্তারা আরও জানান, ইউএসটিআরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্য চুক্তির একটি খসড়া তৈরি করা হয়েছে। নতুন করে দরকষাকষিতে দুই পক্ষ একমত হলে খসড়ায় সংশোধন এনে তা চূড়ান্ত করা হবে।
বাংলাদেশের পণ্যের ওপর প্রথমে ৩৭ শতাংশ এবং পরে্তান শতাংশ 'পাল্টা শুল্ক' ঘোষণা করে আলোচনার সুযোগ রেখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ওয়াশিংটনে তৃতীয় দফার আলোচনা শেষে গত ৩১ জুলাই পাল্টা শুল্ক ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়।
