যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য: ১ বিলিয়ন ডলারের সয়াবিন চুক্তি সই; তবে তুলার চড়া দাম নিয়ে অস্বস্তি
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের কৃষি পণ্যের বাণিজ্য আরও গভীর হতে চলেছে। সোমবারের দুটি ঘটনা—মার্কিন তুলা রপ্তানি বাড়ানোর নতুন উদ্যোগ ও স্থানীয় প্রকিয়াজাতকারকদের পক্ষ থেকে ১ বিলিয়নন ডলারের সয়াবিন কেনার প্রতিশ্রুতি—দুই দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অভিন্ন স্বার্থের বিষয়টিকে সামনে এনেছে।
বাংলাদেশের আমদানিতে মার্কিন তুলার হিস্যা বাড়ানোর পথ খুঁজতে মার্কিন তুলা রপ্তানিকারক, পোশাক ব্র্যান্ড এবং বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস খাতের প্রস্তুতকারকদের প্রতিনিধিরা ঢাকায় এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্যমতে, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট তুলা আমদানির প্রায় ১০ শতাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কম।
দাম ও লিড টাইমের চ্যালেঞ্জ
বৈঠকে বাংলাদেশি আমদানিকারকরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও বেশি তুলা আমদানির ক্ষেত্রে দামের ব্যবধান ও দীর্ঘ শিপিং সময়কে প্রধান বাধা হিসেবে উল্লেখ করেন।
দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক ও তুলা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ভিয়েলাটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রেজাউল হাসনাত (ডেভিড হাসনাত) বলেন, 'মার্কিন তুলার দাম কেজিতে প্রায় ১২ সেন্টের বেশি—আর এক সেন্টের পার্থক্যও আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই অতিরিক্ত খরচ কে বহন করবে? তাছাড়া মার্কিন তুলা সরবরাহের লিড টাইমও [সরবরাহের প্রয়োজনীয় সময়] বেশি।'
শিল্প খাতের নেতারা বলেন, এই দামের পার্থক্যের কারণে প্রতিবেশী ভারত ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের তুলার তুলনায় মার্কিন তুলা কম প্রতিযোগিতামূলক হয়ে পড়ে।
বিটিএমএর সহসভাপতি সালেউদ জামান খান বলেন, 'মার্কিন তুলার জন্য বেশি দাম দিলেও, সেই তুলা দিয়ে তৈরি পোশাকের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা অতিরিক্ত কোনো অর্থ দেন না। যেহেতু মার্কিন ক্রেতাদের জন্য মার্কিন তুলা ব্যবহার বাধ্যতামূলক নয়, তাই আমদানিকারকরা স্বাভাবিকভাবেই সস্তা বাজার থেকে তুলা কেনেন।'
প্রণোদনা ও শুল্ক সুবিধার আহ্বান
বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা সফররত মার্কিন ব্র্যান্ডগুলোকে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা দিয়ে তৈরি পোশাকের জন্য হয় ভালো দাম দিয়ে অথবা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে এই খরচের ব্যবধান কমাতে সাহায্য করার আহ্বান জানান।
তারা প্রস্তাবিত 'পারস্পরিক শুল্ক কাঠামো'র (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ ফ্রেমওয়ার্ক) বিষয়টিও তুলে ধরেন, যার আওতায় বাংলাদেশি পণ্যের কাঁচামালের অন্তত ২০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হলে সেই পণ্যগুলো যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক ছাড় পেতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজনীয় আইন এখনও প্রণয়ন হয়নি এবং এর নথিপত্র প্রস্তুতের প্রক্রিয়াও বেশ জটিল।
বৈঠকে যোগ দেওয়া একজন আমদানিকারক বলেন, 'আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়াতে আগ্রহী, কিন্তু এই উচ্চমূল্য সমন্বয়ের একটি সুস্পষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে—প্রতিনিধিদলকে এ কথা বলেছি।'
তবে বিটিএমএর পরিচালক ও লিটল স্টার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলম উল্লেখ বলেন, দাম নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও মার্কিন তুলার উন্নত মান এই ব্যবধানের কিছুটা কমাতে সাহায্য করে—যদিও তা কেজিতে পুরো ১২ সেন্টের পার্থক্যকে পুষিয়ে দেয় না।
এই বৈঠকে ইকম ইউএসএ, কারগিল কটন, লুই ড্রেফাস কোম্পানি, ওলাম কটন, ক্যারোলিনা কটন গ্রোয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন, স্ট্যাপলকটন কো-অপারেটিভ এবং গ্যাপ ইনক. ও কন্টুর ব্র্যান্ডস-সহ প্রধান মার্কিন তুলা ব্যবসায়ী ও পোশাক ব্র্যান্ডগুলোর প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
বিটিএমএর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ প্রায় ৮৪ লাখ বেল তুলা আমদানি করেছে, যার বাজারমূল্য ৩.৯২ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে মাত্র ৭ শতাংশের কিছু বেশি। আমদানিকৃত তুলার ৪৩ শতাংশ এসেছে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে ও ১৯ শতাংশ এসেছে ভারত থেকে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড টারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন আমদানিতে খরচ খুব একটা বাড়বে না।
'তবে সোর্সিংয়ের চড়া খরচই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মার্কিন তুলা আমদানিতে নিরুৎসাহিত করে। তুলার দাম বেড়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই আমদানিকারকরা দ্বিধায় পড়বেন,' বলেন তিনি।
এই সমস্যা সমাধানে তিনি বাংলাদেশে মার্কিন তুলার জন্য একটি নির্দিষ্ট ওয়্যারহাউস স্থাপনের মাধ্যমে লিড টাইম কমিয়ে আনার পরামর্শ দেন।
মোস্তফা আবিদ খান আরও বলেন, 'মার্কিন তুলা যদি স্থানীয়ভাবে মজুত থাকে, তবে ক্রেতারা প্রয়োজনমতো তা কিনতে পারবেন—যা পুরো প্রক্রিয়াটিকে আরও সাশ্রয়ী করে তুলবে।'
১ বিলিয়ন ডলারের সয়াবিন চুক্তি: গভীর হচ্ছে কৃষি বাণিজ্য
একই দিনে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস দ্বিপাক্ষিক কৃষি বাণিজ্যে আরেকটি বড় অগ্রগতির ঘোষণা দিয়েছে। ইউএস সয়াবিন এক্সপোর্ট কাউন্সিল (ইউএসএসইসি) ও বাংলাদেশের শীর্ষ তিন সয়াবিন প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান—মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ ও ডেল্টা অ্যাগ্রোর একটি কনসোর্টিয়ামের মধ্যে ১ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়েছে।
এর আগে একই দিনে মাহবুব গ্রুপ ও কেজিএস গ্রুপের সঙ্গেও আলাদা চুক্তি সই করে ইউএসএসইসি।
এ চুক্তির আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন কিনবে। আশা করা হচ্ছে, এতে বাংলাদেশে মার্কিন সয়াবিন রপ্তানি তিনগুণ বাড়বে।
যুক্তরাষ্ট্রের চার্জ ডি'অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি জ্যাকবসন এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, এটি 'উচ্চমানের মার্কিন কৃষি পণ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের প্রতিফলন।'
এক বিবৃতিতে তিনি দূত বলেন, 'বাণিজ্য ৩৫০ মিলিয়ন ডলার থেকে তিনগুণ বেড়ে ১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া বাংলাদেশি বাজারের শক্তি ও সম্ভাবনা এবং আমেরিকার কৃষক পরিবার ও বাংলাদেশের প্রক্রিয়াজাতকারী পরিবারগুলোর মধ্যে অংশীদারত্বের প্রমাণ দেয়।'
ডেল্টা অ্যাগ্রোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক মার্কিন সয়াবিনের মানের প্রশংসা করে বলেন, ভবিষ্যতে জ্বালানি পণ্যের ক্ষেত্রেও এই সহযোগিতা প্রসারিত হতে পারে, যা শক্তিশালী লজিস্টিকস ও ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে ৩.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করবে।
সিটি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাসান বলেন, এই অংশীদারত্ব বাংলাদেশের খাদ্য সরবরাহ চেইনে নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করবে।
মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল এই সমঝোতা স্মারকটিকে 'মার্কিন কৃষক ও বাংলাদেশি পরিবারগুলোর মধ্যে সেতুবন্ধন' হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি আরও জানান, চলতি বছর মেঘনা গ্রুপের সয়াবিন আমদানি প্রায় ১০ লাখ টনের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
ক্রাশিং ও রিফাইনিং (পরিশোধন) সক্ষমতায় দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকে সমর্থন জোগাতে তিনি নীতিনির্ধারকদের প্রতি সয়াবিন মিলের ওপর শুল্ক যৌক্তিক করার আহ্বান জানান। এটি খাদ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে এবং কর্মসংস্থান রক্ষায় সহায়তা করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বাংলাদেশ বর্তমানে বছরে প্রায় ২৫ লাখ টন সয়াবিন আমদানি করে, যার প্রধান উৎস যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা। আশা করা হচ্ছে, নতুন এই চুক্তির মাধ্যমে ঢাকার শীর্ষ সরবরাহকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান আরও সুসংহত হবে।
