চলতি বছরের মধ্যেই ইপিএ সই, বিনিয়োগ আকর্ষণে ব্যবসাবান্ধব সংস্কার করতে বলেছে জাপান

বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগ বাড়াতে চলতি বছরের মধ্যেই দেশটির সঙ্গে ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ) স্বাক্ষর সই করার আহ্বান জানিয়েছে জাপান। একই সঙ্গে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কার, স্থিতিশীল ও বিনিয়োগবান্ধব করনীতি নিশ্চিত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া সহজ করার তাগিদ দিয়েছে।
গত এপ্রিলে টোকিওতে অনুষ্ঠিত জাপান–বাংলাদেশ পাবলিক–প্রাইভেট জয়েন্ট ইকোনমিক ডায়ালগ (পিপিইডি)–এ জাপানি কর্মকর্তারা এসব দাবি তোলেন। বৈঠকে তারা বাংলাদেশে ব্যবসার বেশকিছু প্রতিবন্ধকতা—অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রণোদনা, ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা, আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যাংকিং প্রক্রিয়া, এবং দক্ষ শ্রমিক ও অবকাঠামো ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন, যেগুলোর জরুরি সমাধান দরকার।
এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের জাপান সফরের আগে। বৈঠকের কার্যবিবরণী সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোতে পাঠানো হয়েছে, যার একটি অনুলিপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর হাতে এসেছে।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বাণিজ্য টিকিয়ে রাখতে ইপিএকে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে দেখা হচ্ছে
জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক এখন অনেকটাই নির্ভর করছে সময়মতো ইপিএ স্বাক্ষরের ওপর। ৩–১২ সেপ্টেম্বর টোকিওতে এই চুক্তির সপ্তম দফা আলোচনায় পণ্য, সেবা, বিনিয়োগ, ই-কমার্স এবং মেধাস্বত্বসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়।
গতকাল বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে জানান, "সেপ্টেম্বরেই ফাইনাল রাউন্ডের আলোচনা শেষ হয়েছে। জাপান আমাদের তাদের ট্যারিফ ও সার্ভিস শিডিউল দিয়েছে, আমরাও তাদের আমাদেরটা দিয়েছি। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, উভয় পক্ষের ডকুমেন্টই সামঞ্জস্যপূর্ণ।"
তিনি আরও বলেন, "আমরা নভেম্বরের মধ্যে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সব আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে ডিসেম্বরেই স্বাক্ষরের লক্ষ্য নিয়েছি। তবে জাপানের আইনি প্রক্রিয়া শেষ হতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। এগুলো প্রস্তুত হলেই ইপিএ সাইন হবে।"
বর্তমানে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদায় জাপানের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে। এই সুবিধা ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের পর শেষ হবে এবং তখন বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে ১৮ শতাংশ শুল্ক দিতে হবে। ইপিএর লক্ষ্য এই শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বজায় রাখা এবং ১৭টি অগ্রাধিকার খাতে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ অর্থবছরে জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানি ১.৪১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ২.৯২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে দেশে জাপানের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) দাঁড়িয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) জানায়, বর্তমানে ৩৩০টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে—এর মধ্যে ৫৭.৭ শতাংশ প্রতিষ্ঠানই তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। জাপানের লায়ন করপোরেশন, ওনোদা ও নিক্কা কেমিক্যাল কো. লিমিটেড ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (বিএসইজেড) কারখানা স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ করেছে।
এপ্রিলে অনুষ্ঠিত জাপান–বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংলাপে জাপানি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের উত্থাপিত উদ্বেগগুলোর জবাবে প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া আশ্বাস দেন যে, চলতি বছরের মধ্যেই ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (ইপিএ) সই করা হবে এবং বাংলাদেশে জাপানি বিনিয়োগকারীরা যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন সেগুলো সমাধানে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
এই সংলাপে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া, আর জাপানের পক্ষে নেতৃত্ব দেন তাকেহিকো মাতসুয়া, যিনি জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় (এমইটিই) এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী।
বাংলাদেশ-জাপান অর্থনৈতিক সংলাপ বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সংযুক্তি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আলোচনা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। এই ফোরামের আগের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০২৩ সালের এপ্রিলে।
টোকিও সংলাপে জাপানের তাগিদ: দ্রুত সংস্কার ও স্থিতিশীল নীতি
টোকিও সংলাপে জাপানি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশকে দ্রুত ইপিএ সই এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের বাধাগুলো দূর করার আহ্বান জানান।
জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের (এমইটিই) উপ-মহাপরিচালক গাকু ইয়োদা বলেন, ২০২৬ সালে বাংলাদেশের এলডিসি থেকে নির্বিঘ্ন উত্তরণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইপিএ দ্রুত শেষ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, "উভয় সরকারকেই ব্যবসায়িক মহলের কথা শোনা এবং যৌথভাবে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে।"
কুকুবু ফুমিয়া, জাপান-বাংলাদেশ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা কমিটির চেয়ারম্যান, বলেন, "ইপিএ স্বাক্ষর এখন খুবই জরুরি। ঢাকায় ৮৫ শতাংশ জাপানি কোম্পানি আশা করছে, এটি এ বছরই চূড়ান্ত হবে।"
জেট্রো বাংলাদেশের প্রতিনিধি আন্দো ইউজি জানান, সরকার পরিবর্তন সত্ত্বেও জাপানি প্রতিষ্ঠানগুলো আগামী এক থেকে দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে আশাবাদী—বিশেষ করে কেমিক্যাল ফাইবার, রপ্তানিমুখী ও দেশীয় বাজারকেন্দ্রিক শিল্পগুলোতে।
তিনি প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেন—ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট পেতে ১৪ মাস পর্যন্ত বিলম্ব, অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া কর প্রণোদনার হঠাৎ পরিবর্তন, এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য না থাকা ব্যাংকিং প্রক্রিয়াগুলোকে।
জাপান আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) দক্ষিণ এশিয়া মহাপরিচালক ইয়ামাদা তেতসুয়া বলেন, বাংলাদেশের এফডিআই–টু–জিডিপি অনুপাত মাত্র ০.৩ শতাংশ, যা জটিল নিয়ম, দুর্বল অবকাঠামো ও দক্ষ জনশক্তির ঘাটতির ফল। উৎপাদনশীলতা ও বিনিয়োগ প্রস্তুতি বাড়াতে জাইকা এসব সংস্কারে সহায়তা করছে বলে জানান তিনি।
জাপানি কোম্পানিগুলোর নির্বাহীরাও বৈঠকে নির্দিষ্ট বেশকিছু দাবি তোলেন। যেমন কাফকো জাপান গ্যাস সরবরাহ চুক্তিতে স্থিতিশীলতা চায়, আর ওনোদা ইনকর্পোরেশন নারায়ণগঞ্জের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রিপেইড গ্যাস মিটার অ্যাসেম্বলি প্ল্যান্ট স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে।
জাপানের কৃষি, বন ও মৎস্য মন্ত্রণালয়ের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার উদীয়মান অঞ্চল বিষয়ক বিভাগের পরিচালক শিমাদা মিতসুও বাংলাদেশ-জাপান খাদ্য ও কৃষি খাতের সহযোগিতার বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরেন। বাংলাদেশে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা এবং অস্পষ্ট প্রক্রিয়াগুলো নির্মুল করা এখন জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি: সংস্কার ও দ্রুত ইপিএ সই
বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের প্রধান ও প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, আমরা এ বছরই ইপিএ স্বাক্ষর করতে চাই। জাপানি বিনিয়োগকারীদের সমস্যাগুলোর সমাধানেও আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি জানান, ভিসা, ওয়ার্ক পারমিট ও কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজীকরণে উদ্যোগ চলছে, এবং ওনোদা ও কাফকো'র মতো প্রতিষ্ঠান যেসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে– সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।
জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. দাউদ আলী বলেন, প্রধান উপদেষ্টা ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আইনের শাসন ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের সংস্কার করছে।
তিনি ভাষা প্রতিবন্ধকতাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশে জাপানি ভাষা ও প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি তিনি দেশটিতে সবজি রপ্তানি বাড়ানোর আগ্রহ প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মহাপরিচালক মো. আরিফুল হক বলেন, সরকারের লক্ষ্য এফডিআই জিডিপির ০.৩ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশে উন্নীত করা—যার জন্য নীতি ধারাবাহিকতা, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ ও স্থিতিশীল সম্পদ সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা আবু সালেহ মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন বলেন, পেমেন্ট-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে, রিজার্ভ ও বিনিময় হারও এখন স্থিতিশীল।
এনবিআর সদস্য মো. মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, শুল্ক ও কর সংস্কারে অগ্রগতি হচ্ছে। ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে, এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে চালু হওয়া নতুন কাস্টমস বন্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিবিএমএস) পণ্য ছাড়ের সময় কমাবে ও স্বচ্ছতা বাড়াবে।