উপসাগরীয় অঞ্চলের বন্ধুদের আর রক্ষা করবে না বা পারবে না যুক্তরাষ্ট্র

এই বছরের মে-তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কাতারের রাজধানী দোহায় বিমানবন্দরের একটি হ্যাঙ্গারে দাঁড়িয়ে দেশটির পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি যখন বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, তার পেছনে ছিল একদল মার্কিন সেনা। তার বাম পাশে একটি এমকিউ-৯ রিপার ড্রোন আর ডান পাশে একটি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান। সামরিক শক্তির এই প্রদর্শনীর মাধ্যমে ট্রাম্প তার মিত্রদের উদ্দেশ্যে হয়ত বার্তা দিতে চেয়েছিলেন।
সেদিন তিনি বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র কিংবা আমাদের সঙ্গীদের রক্ষা করার প্রয়োজন হলে আমি কখনোই আমেরিকান শক্তি প্রয়োগে দ্বিধা করব না। আর এ দেশটি আমাদের মহান মিত্রদের মধ্যে অন্যতম।'
কিন্তু ৯ সেপ্টেম্বর, আমেরিকার আরেক মিত্র দেশই তার সেই 'মহান মিত্র দেশ' কাতারের ওপর হামলা চালায় এবং সেখানে ব্যবহার করা হয় মার্কিন যুদ্ধ বিমান। সেদিন ইসরায়েলের বিমানবাহিনী দোহায় একটি আবাসিক ভবন লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালায়। ভবনটিতে হামাসে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার কথা ছিল। তবে হামাসের দাবি, ইসরায়েলের এ হামলা ব্যর্থ হয়েছে। ঘটনায় হামাসের নিম্নপদস্থ পাঁচজন নিহত হয়েছে বলে জানা গেলেও, ঘটনার পর থেকে ওই শীর্ষ নেতাদের দেখা যায়নি।
এটি শুধু একটি সামরিক ব্যর্থতাই নয়। এই হামলা গাজায় চলমান যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেস্তে দিতে পারে। একইসঙ্গে উপসাগরীয় অঞ্চলের অনেক প্রভাবশালী নেতা যা আশঙ্কা করছিলেন তা-ই আরও জোরদার হলো। তারা আশঙ্কা করছিলেন, এখন ইসরায়েল হয়ে উঠবে আঞ্চলিক প্রভাবশালী শক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্র আর তাদের নিরাপত্তা দিকে পারবে না।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যখন প্রায় ১,৪০০ ইসরায়েলিকে হত্যা করে বা অপহরণ করে, তখন থেকে ইসরায়েল সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় যে তারা হামাসের নেতাদের খুঁজে বের করবে। তবে এতদিন তারা কাতারে হামলা চালানো থেকে বিরত ছিল। ছোট্ট এই উপসাগরীয় রাষ্ট্রেই রয়েছে হামাসের রাজনৈতিক কার্যালয় এবং একইসঙ্গে আমেরিকার সেন্ট্রাল কমান্ডের আঞ্চলিক সদর দপ্তর।
কাতারে হামলার পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিল মোসাদ (ইসরায়েলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা) এবং দেশটির সেনা কর্মকর্তারা। তাদের যুক্তি ছিল, এতে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি আলোচনার উদ্যোগ ব্যাহত হবে এবং গাজায় এখনো জিম্মি থাকা লোকজনের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে। তবুও প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই হামলার নির্দেশ দেন। তার কারণ হিসেবে আংশিকভাবে ৮ সেপ্টেম্বর জেরুজালেমে এক বন্দুক হামলায় ছয়জন বেসামরিক নাগরিক নিহত ঘটনাকে দায়ী করা হয়। ওই ঘটনায় নেতানিয়াহুর সরকার কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে।
এ ঘটনার মধ্য দিয়ে কাতার হলো ষষ্ঠ দেশ যে ৭ অক্টোবর হত্যাযজ্ঞের পর ইসরায়েলের হামলার শিকার হয়েছে। যদিও ইসরায়েল দাবি করতে পারে, প্রকৃত হুমকির কারণেই তারা সেখানে হামলা চালিয়েছে। হামলার শিকার হওয়া অন্যরা হলো—ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও ইয়েমেন। তাছাড়া আঞ্চলিক বিভিন্ন গোষ্ঠিকে সহায়তা দানকারী ইরানেও ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে। কাতারের ক্ষেত্রে এমন কোনো দাবির সুযোগ নেই।
ইসরায়েল হামলাটি কোনো পূর্বনির্ধারিত উদ্দেশ্যে, বা আসন্ন কোনো হুমকি বা ভবিষ্যতে কোনো হুমকি তৈরি করতে পারে এমন কোনো কারণে চালায়নি। তারা মূলত এই সার্বভৌম রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে প্রতিশোধের লক্ষ্যেই এ হামলা চালিয়েছে।
১০ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ বিন জায়েদ দোহায় গিয়ে কাতারের আমিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরদিন সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্সের যাওয়ার কথা ছিল। একসময় কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা প্রতিবেশী দেশগুলোর এই সফর ছিল প্রকাশ্যে সমর্থন।
উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদে (জিসিসি) আরব দেশটিকে দীর্ঘদিন ধরে 'কালো ভেড়া' হিসেবে দেখা হয়েছে। হামাসসহ ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি দেশটির সমর্থন প্রতিবেশীদের ক্ষুব্ধ করেছিল। একইভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল আল জাজিরাকে পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণেও। এসব কারণে ২০১৭ সালে চারটি আরব দেশ কাতারের ওপর ভ্রমণ ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং ২০২১ সালে তা আবার তুলেও নেয়।
তবে এখন কাতারের সঙ্গে এসব মতবিরোধ দেশগুলোর নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের তুলনায় তুচ্ছ। জিসিসি বরাবরই শান্ত থাকার কারণে খ্যাতি অর্জন করেছে। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে সৌদি আরব ও ইউএই ইরান ও তার মিত্রদের হামলার শিকার হচ্ছে। তাদের দীর্ঘদিনের রক্ষক আমেরিকার প্রতিক্রিয়ায় উভয়ই হতাশ। কাতারও এর বাইরে নয়; এ বছর ইতিমধ্যে দুইবার বোমা হামলার শিকার হয়েছে দেশটি। প্রথমবার জুনে ইরান বোমা হামলা চালায়, যা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার পাল্টা জবাব।
এ কারণেই ট্রাম্প প্রশাসন এখন বিব্রত বোধ করছে। হামলার পর হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট সাবধানে শব্দচয়ন করে বিবৃতি পাঠ করেন। সেখানে জানানো হয়, হামলা শুরু হওয়ার পরই তারা ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। আর ঘটনার কথা মার্কিন সেনাবাহিনী তাদের জানিয়েছে, ইসরায়েল নয়।
পরে ট্রাম্প সামাজিক মাধ্যমে একই ধরনের বার্তা দেন এবং প্রতিশ্রুতি দেন যে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কাতারের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি চূড়ান্ত করবেন। তিনি আরও অঙ্গীকার করেন যে কাতারকে আর কখনো লক্ষ্যবস্তু করা হবে না (যদিও পরে নেতানিয়াহু ভিন্ন ইঙ্গিত দেন)।
কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ভিন্ন দাবি করেছেন। তাদের কথায়, ট্রাম্প হয়তো হামলার সঠিক সময় জানতেন না, তবে পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিলেন। তিনি সবুজ সংকেত না দিলেও লাল সংকেতও দেননি। ওয়াশিংটনের ভেতরের সূত্রগুলো ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা দিলেও সবাই এক বিষয়ে একমত যে এ বিষয়ে ট্রাম্প প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। এক সাবেক পেন্টাগন কর্মকর্তা একে শুধু 'বিব্রতকর' বলে আখ্যা দিয়েছেন।
ইসরায়েলের কর্মকর্তারাও এই অভিযান এবং এর ফলাফলের কারণে চরম ক্ষুব্ধ ছিলেন। এক সাবেক গুপ্তচর প্রধান বলেছেন, 'এটি একটি বিশাল ব্যর্থতা। তারা আশা করেছিল ট্রাম্প এ ব্যাপারে সমর্থন দেবেন, কিন্তু এটি ছিল একটি বড় ভুল হিসাব।'
গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, তারা ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে। ২০২০ সালে ইউএই এবং বাহরাইন উভয়েই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সৌদি আরবও ৭ অক্টোবরের আগে তাদের নিজস্ব স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি স্বাক্ষরের কাছাকাছি ছিল। আমেরিকার কর্মকর্তারা উপসাগরীয় রাজাদের ইসরায়েলের সঙ্গে আঞ্চলিক এয়ার-ডিফেন্স অংশীদারিত্বে যোগ দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন।
কিন্তু ৭ অক্টোবরের পরে সব কিছুই কঠিন হয়ে গেছে। গাজা যুদ্ধ ইসরায়েলকে আরব বিশ্বের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় করে তুলেছে, এবং উপসাগরীয় শাসকরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন যে ইসরায়েলের ইরান ও তার মিত্রদের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংঘাত শেষ পর্যন্ত তাদেরও টেনে আনতে পারে এবং দোহায় হামলা এই ধারণাটিকে আরও দৃঢ় করেছে। তারা ধারণা করছিল, কাতার বৈঠক থেকে হয়তো অঞ্চলটি স্থিতিশীল হবে তার বদলে তাদের কাছে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া বিপরীতমুখী বলেই মনে হচ্ছে।