দোহায় হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলের হামলা: কাতারের কূটনীতি কি তবে ভেস্তে গেল?

প্রায় এক বছর আগে হামাসের নেতা ও প্রধান আলোচক খালিল আল-হায়্যার সাথে কাতারের দোহায় সাক্ষাৎ করেছিলেন বিবিসির প্রতিবেদক জেরেমি বোয়েন। তারা যে বাড়িতে মিলিত হয়েছিলেন, তা মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) ইসরায়েলি হামলার কবলে পড়া ভবনের কাছেই অবস্থিত।
গাজার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই খালিল আল-হায়্যা প্রধান হামাস আলোচক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। তিনি কাতার ও মিসরীয় মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইসরায়েলি ও মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে বার্তা আদান-প্রদান করতেন।
যখন কখনও যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা তৈরি হতো, আল-হায়্যা ও মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়া অন্যান্য নেতারা ইসরায়েলি ও আমেরিকান প্রতিনিধিদলের খুব কাছাকাছি থাকতেন।
হামলার সময়ও তারা চলমান আমেরিকান কূটনৈতিক প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা করছিলেন, যা গাজায় যুদ্ধ শেষ ও বাকি ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দিতে সাহায্য করতে পারত।
ইসরায়েলের দ্রুত হামলার ঘোষণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রস্তাবনা আসলে হামাস নেতৃত্বকে এক জায়গায় লক্ষ্য করার জন্য একটি ফাঁদ হতে পারে।
গত ৩ অক্টোবর, যখন আল-হায়্যা বিবিসিকে সাক্ষাত দেয়ার জন্য এক সাধারণ, কম উঁচু ভিলায় প্রবেশ করলেন, তখন তার নিরাপত্তা ব্যবস্থা খুবই সীমিত ছিল। সবার ফোন সরিয়ে ফেলতে হয়েছিল, এবং মাত্র কয়েকজন বডিগার্ড তার সঙ্গে ভেতরে এসেছিল। আর বাইরে সাদা পোশাকে কাতারি পুলিশেরা একটি গাড়িতে বসে ধূমপান করছিলেন।
আল-হায়্যা ও তার কর্মকর্তারা নিশ্চিত ছিলেন যে কাতার নিরাপদ, তাই তারা তুলনামূলকভাবে খোলামেলা চলাফেরা করতেন।
এর কয়েক মাস আগে, ৩১ জুলাই ২০২৪, ইসরায়েল তেহরানে হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়েকে হত্যা করেছিল। তখন তিনি প্রেসিডেন্ট মাসউদ পেজেশকিয়ান-এর শপথ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছিলেন।
সাম্প্রতিক কয়েক দশকে কাতার নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের 'সুইজারল্যান্ড' হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেছে—একটি জায়গা যেখানে শত্রুরাও চুক্তি করতে পারে। আমেরিকানরাও আফগান তালেবানের সঙ্গে এই দোহায় আলোচনায় বসেছিল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার পর প্রায় দুই বছর ধরে কাতার ছিল যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফের নেতৃত্বে শান্তি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে পড়েছিল। এখন তা সম্পূর্ণ ধ্বংস। এক সিনিয়র পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, 'কোনো কূটনীতি এখন নেই।'
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরায়েলিদের জানিয়েছেন, তাদের শত্রুরা কখনও আর নিরাপদে ঘুমাতে পারবে না এবং ৭ অক্টোবরের হামলার দায়ে তারা মূল্য চুকাচ্ছে।
গাজায় ইসরায়েলের হামলা তীব্র হচ্ছে। দোহায় হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে, ইসরায়েলি সেনারা গাজা সিটির সব ফিলিস্তিনিকে দক্ষিণে সরার নির্দেশ দেয়। ধারণা করা হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ নাগরিক সেখান থেকে সরে গিয়েছেন।
টেলিভিশনে নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের উদ্দেশে বলেন, 'এই খুনিদের দ্বারা বিচলিত হবেন না। আপনারা আপনার অধিকার ও ভবিষ্যতের জন্য লড়ুন। আমাদের সঙ্গে শান্তি করুন। ট্রাম্পের প্রস্তাব গ্রহণ করুন। এগুলো করতে পারলে আমরা একটি ভিন্ন ভবিষ্যৎ দিতে পারি, তবে আপনাদের আগে এই মানুষগুলো সরাতে হবে।'
তবে গাজার মানুষদের কাছে এই বার্তা ফাঁকা বুলি বৈকি আর কিছু নয়। ইসরায়েল ইতিমধ্যেই তাদের শত শত বাড়ি, হাসপাতাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল ধ্বংস করেছে।
গাজায় ক্ষুধা, মানবিক বিপর্যয় ও শহরে অভুক্তি পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই বিরাজ করছে। আরও মানুষকে জোর করে সরানো এই ক্ষতি আরও বৃদ্ধি করবে।
ইসরায়েল ইতিমধ্যেই ৬০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি হত্যা করেছে। নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত থেকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক আদালতই ইসরায়েলকে গণহত্যার তদন্ত করছে।
দোহায় হামলা ইঙ্গিত দেয় যে নেতানিয়াহু এবং তার সরকার সব মঞ্চে, শুধু গাজা নয়, নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দৃঢ়। তারা বিশ্বাস করেন যে আমেরিকান সমর্থনে তাদের সেনাবাহিনী তাদের ইচ্ছা জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করতে সক্ষম।
এ ঘটনায় অবশ্য হোয়াইট হাউস থেকে বিরল সমালোচনা এসেছে। কাতার যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যবান মিত্র, যেখানে বড় আমেরিকান সামরিক ঘাঁটি এবং বিনিয়োগ রয়েছে। তবে নেতানিয়াহু মনে করছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প শুধুমাত্র কূটনৈতিকভাবে সীমিত সমালোচনা দিয়ে সন্তুষ্ট হবেন।
ইসরায়েল গাজায় তার সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এই মাসের শেষের দিকে যখন যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশ জাতিসংঘে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা স্বীকৃতির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে, তখন নেতানিয়াহুর অতিবিদ্রোহী জাতীয়তাবাদী মন্ত্রিসভার সদস্যরা পশ্চিম তীরের দখলকৃত ফিলিস্তিনি এলাকায় তার সম্প্রসারণের আহ্বান আরও জোরদার করবেন।