কাতারে হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলের হামলা উপসাগরীয় দেশগুলোর জন্য অপ্রত্যাশিত

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকেই মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে আঘাত করে আসছে ইসরায়েল। গাজা ও পশ্চিম তীর ছাড়াও লেবানন, সিরিয়া এবং ইরানে হামাসের সদস্যদের হত্যা করেছে তারা।
তবে এতদিন কাতারে হামাস নেতাদের লক্ষ্যবস্তু বানায়নি ইসরায়েল। কারণ ছোট্ট এই উপসাগরীয় দেশটি দীর্ঘদিন ধরে হামাস নেতাদের আশ্রয় দিলেও, আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র। পাশাপাশি ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধবিরতি আলোচনার প্রধান স্থানও ছিল কাতার। তাই সেখানকার ভূমিতে আক্রমণ করা ছিল 'সীমা অতিক্রম'।
কিন্তু সেই সীমা অতিক্রম করল ইসরায়েল। ৯ সেপ্টেম্বর দোহার একটি ভিলায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। ধারণা করা হচ্ছে, সেখানে হামাস নেতাদের বৈঠক চলছিল।
এই হামলার বিস্তারিত এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এতে একটি বড় ধাপ অতিক্রম করা হলো। এর প্রভাব শুধু গাজা যুদ্ধের ওপর নয়; আমেরিকা, ইসরায়েল ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সম্পর্কের ওপরও পড়বে।
ইসরায়েলের প্রাথমিক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, গাজায় একটি ভিলায় হামাসের শীর্ষ নেতাদের এক সভা বসেছিল। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আলোচক দলের প্রধান খালিল আল-হাইয়া ও সাবেক প্রধান খালেদ মেশাল। ১৯৯৭ সালে খালেদ ইসরায়েলের হত্যাচেষ্টার লক্ষ্য হয়েছিলেন।
হামাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ওই হামলায় ছয়জন নিহত হয়েছেন। তবে তাদের কোনো শীর্ষ নেতা মারা যাননি। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা এখনো নিশ্চিত করে বলেননি, নেতাদের কেউ নিহত হয়েছেন কি না।
জানা গেছে, ওই বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সম্প্রতি প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা চলছিল। প্রস্তাব অনুযায়ী, হামাসকে অবিলম্বে গাজায় থাকা ৪৮ জন ইসরায়েলি জিম্মিকে (জীবিত ও মৃত) মুক্তি দিতে হবে। তবে এ প্রস্তাব যুদ্ধের স্থায়ী অবসান নয়; এতে সাময়িক যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছে এবং ট্রাম্প ইসরায়েলকে স্থায়ী বিরতিতে রাজি করাবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।
এ বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলেও, মার্চে তা ভেঙে দেয় ইসরায়েল। কূটনীতিকদের ধারণা, নতুন প্রস্তাবও হামাস খারিজ করত, কারণ সেটি ছিল অনেক বেশি নড়বড়ে। তাদের দুশ্চিন্তা ছিল, কীভাবে তা প্রত্যাখ্যান করলে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষুব্ধ হবেন না।
এখন সেই আলোচনা কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কাতারে হওয়া সংলাপ শেষ হয়ে গেছে বলেই মনে হচ্ছে। দেশটি মধ্যস্থতার ভূমিকা ছাড়তেও পারে। আলোচনার নতুন পর্ব শুরু হলে তা সম্ভবত মিশরে হবে।
হামাসের বিদেশভিত্তিক নেতারা নিহত বা অক্ষম হয়ে থাকলে সিদ্ধান্ত নেবেন গাজার সামরিক শাখার প্রধান ইজ্জ আল-দীন আল-হাদ্দাদ। তার বহু যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকলেও, রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা খুব সামান্য।
এই হামলা সফল হলে দেশে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অবস্থান শক্ত হতে পারে। তবে একই সঙ্গে বাড়বে গাজা যুদ্ধ ঘিরে তীব্র বিতর্ক। অধিকাংশ ইসরায়েলি যুদ্ধের অবসান চায়। কিন্তু ডানপন্থি মিত্রদের চাপে প্রধানমন্ত্রী তা মানতে নারাজ। ওই মিত্ররা গাজা পুনর্দখল ও জনসংখ্যা অন্যত্র সরাতে চায়।
এর মধ্যেই কয়েকজন জিম্মির পরিবার বিবৃতি দিয়ে 'গভীর আশঙ্কা' প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, কাতারে হামলার কারণে জিম্মিদের 'মূল্য দিতে হতে পারে'। এক জিম্মির মা লিখেছেন, হামাস নেতাদের হত্যাচেষ্টায় নেতানিয়াহু হয়তো তার ছেলেকেও হত্যা করেছেন।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদক কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—ইসরায়েল যদি কাতারের মাটিতে হামাস নেতাদের হত্যা করে, তা নিয়ে তার উদ্বেগ আছে কি না। তিনি বলেছিলেন, 'আমাদের ভূখণ্ডে কোনো অপরাধ মেনে নেওয়া হবে না। আমরা বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে আমেরিকা ও ইসরায়েলকে জানিয়েছি।' দোহার বিশ্বাস ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। কারণ কাতারে আমেরিকার সেন্ট্রাল কমান্ডের আঞ্চলিক সদর দপ্তর রয়েছে এবং দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের 'প্রধান নন-ন্যাটো মিত্র' হিসেবে স্বীকৃত।
হামলার পর নেতানিয়াহু বলেন, এটি ছিল সম্পূর্ণ ইসরায়েলের নিজস্ব অভিযান। তিনি জানান, 'ইসরায়েল পরিকল্পনা করেছে, ইসরায়েলই তা পরিচালনা করেছে এবং ইসরায়েলই পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছে।' তার এই ভাষা অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দায়মুক্তি দেওয়ার মতো শোনায়। হামলার দুই দিন আগে ট্রাম্প হামাসকে 'শেষ সতর্কবার্তা' দিয়ে বলেছিলেন, সমঝোতায় না এলে এর পরিণতি ভোগ করতে হবে।
হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলাইন লেভিট বলেন, এই হামলা ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য পূরণে সহায়ক নয়। তিনি আরও জানান, ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী হামলা শুরু হওয়ার পরেই অবহিত করে। এরপর তিনি তার মধ্যপ্রাচ্য দূত স্টিভ উইটকফকে কাতার সরকারকে সতর্ক করতে নির্দেশ দেন।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের একজন বলেন, 'আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্প যা করলেন, তা করা যায় না।' কারও মতে, ট্রাম্প আগেই বিষয়টি জানতেন, কিন্তু হামলা ব্যর্থ মনে হওয়ায় তিনি নিজেকে দূরে রাখেন। তবে কাতারের কূটনীতিক মাজেদ আল-আনসারি জানিয়েছেন, তাদের দেশকে জানানো হয়েছিল তখনই, যখন বোমা পড়তে শুরু করেছে।
ট্রাম্প যখনই বিষয়টি জেনেছেন না কেন, তিনি কাতারে হামলা ঠেকাতে পারেননি বা চাননি। অথচ কাতারসহ উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) দেশগুলো বরাবরই আমেরিকার নিরাপত্তা নিশ্চয়তায় আস্থা রেখেছিল।
কিন্তু সেই নিশ্চয়তা অনেক আগেই নড়বড়ে হয়ে গেছে। ২০১৯ সালে ইরান সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলা চালায়। ২০২২ সালে ইরান-সমর্থিত এক মিলিশিয়া আবুধাবিতে ড্রোন হামলা করে তিনজনকে হত্যা করে। চলতি বছরের জুনে ইরান কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। সেটি ছিল ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো মার্কিন হামলার প্রতিশোধ—যার বিরোধিতা করেছিলেন উপসাগরীয় শাসকেরা। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা আমেরিকার প্রতিশ্রুতিকে আরও অবমূল্যায়ন করল।
ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করায় কাতারকে বরাবরই জিসিসির 'ব্ল্যাক শিপ' বলা হয়। তবু প্রতিবেশী দেশগুলো দ্রুত ইসরায়েলের হামলা নিন্দা জানিয়েছে। সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমান কাতারের আমিরকে ফোন করে হামলাকে 'অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড' বলেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্টের কূটনৈতিক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাশ একে 'বিশ্বাসঘাতকতামূলক হামলা' বলে অভিহিত করেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই সমালোচনা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ ২০২০ সালে তারাই প্রথম ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল এবং অঞ্চলটিতে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্রে পরিণত হয়েছিল।
মাসের পর মাস ধরে জিসিসির কর্মকর্তাদের মধ্যে দুটি ভয় বেড়েছে—লাগামহীন ইসরায়েল অঞ্চলে প্রভাবশালী শক্তি হয়ে উঠছে, আর এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে তাদের দেশেও। কাতারে ইসরায়েলের হামলা সেই দুই আশঙ্কাকেই আরও দৃঢ় করল।