মাত্র ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে ৬ দেশে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল

মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া, তিউনিসিয়া, কাতার এবং ইয়েমেন—এই ছয় দেশে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। বিস্তৃত এই আগ্রাসনে বিভিন্ন স্থানে প্রাণহানি ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে।
কাতার
গাজায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার সময় কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের একটি নেতৃত্বাধীন দপ্তরে বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। মঙ্গলবারের এই হামলায় ছয়জন নিহত হন।
নিহতদের মধ্যে রয়েছেন হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা খলিল আল-হাইয়ার ছেলে, আল-হাইয়ার দপ্তরের পরিচালক, তিন দেহরক্ষী এবং একজন কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা। তবে হামাসের শীর্ষ নেতারা অক্ষত রয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, এই অভিযান সীমান্তের বাইরে চালানো ধারাবাহিক হামলার অংশ। গত ৭২ ঘণ্টায় এটি ছিল ষষ্ঠ দেশ যেখানে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে মোট সাতটি দেশে অভিযান চালানো হলো।
গাজা
এদিকে গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার বোমাবর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। সোমবার থেকে হামলায় কমপক্ষে ১৫০ জন নিহত এবং ৫৪০ জনের বেশি আহত হয়েছেন।
সোমবার অনাহারে আরও ছয়জন মারা যান। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় চলমান ইসরায়েলি অভিযানে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৬৪ হাজার ৬৫৬ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৪০৪ জন অনাহারে মারা গেছেন। এছাড়া হাজার হাজার মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
লেবানন
যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সোমবার স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান পূর্ব লেবাননের বেকা উপত্যকা ও হারমেল জেলায় হামলা চালায়, এতে অন্তত পাঁচজন নিহত হন।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর দাবি, তারা হেজবুল্লাহর অস্ত্রাগার এবং সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। তবে, এই দাবির সত্যতা স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি। হেজবুল্লাহ এখনও পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি।
গত নভেম্বরে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি চুক্তির এটি সর্বশেষ লঙ্ঘন। এই যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েল প্রায় প্রতিদিন লেবাননের ভূখণ্ডে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে হামলা অব্যাহত রেখেছে। একইসাথে, যুদ্ধবিরতির শর্ত লঙ্ঘন করে তারা পাঁচটি সীমান্ত ফাঁড়িতে নিজেদের দখল বজায় রেখেছে।
সিরিয়া
সোমবার গভীর রাতে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সিরিয়ার বেশ কয়েকটি স্থানে হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাজ্যের সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) জানিয়েছে, এই হামলায় হোমস প্রদেশের একটি সিরীয় বিমানঘাঁটি এবং লাতাকিয়ার কাছে একটি সামরিক ব্যারাকে আঘাত হেনেছে।
সিরিয়ার পররাষ্ট্র ও প্রবাসী মন্ত্রণালয় এই হামলাকে তাদের সার্বভৌমত্বের 'প্রকাশ্য লঙ্ঘন' এবং জাতীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য 'সরাসরি হুমকি' বলে নিন্দা জানায়। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম এই হামলাকে ইসরায়েলের 'ধারাবাহিক আগ্রাসী কার্যকলাপের' অংশ হিসেবে উল্লেখ করে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতনের পর থেকে ইসরায়েল সিরিয়াজুড়ে সামরিক স্থাপনা ও অবকাঠামো লক্ষ্য করে শত শত হামলা চালিয়েছে। তারা দখলকৃত গোলান মালভূমিতেও তাদের উপস্থিতি বাড়িয়েছে, দামেস্কের সাথে ১৯৭৪ সালের একটি নিরস্ত্রিকরণ চুক্তি লঙ্ঘন করে ডিমিলিটারাইজড বা নিরস্ত্র অঞ্চলটি দখল করে নিয়েছে।
এসওএইচআর-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েল চলতি বছর এ পর্যন্ত প্রায় ১০০টি হামলা চালিয়েছে, যার মধ্যে ৮৬টি বিমান হামলা এবং ১১টি স্থল হামলা রয়েছে। এসব হামলায় প্রায় ১৩৫টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে এবং ৬১ জন নিহত হয়েছেন।
তিউনিসিয়া
গাজাগামী 'গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা' (জিএসএফ)-এর প্রধান জাহাজ 'ফ্যামিলি বোট'-এ তিউনিসিয়ার সিদি বু সাইদ বন্দরে নোঙর করা অবস্থায় সোমবার গভীর রাতে সন্দেহভাজন ইসরায়েলি ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। পর্তুগালের পতাকাবাহী ২৩ মিটার দীর্ঘ জাহাজটিতে হামলার পর আগুন ধরে যায়।
হামলার সময় বহরের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যসহ মোট ছয়জন জাহাজে অবস্থান করছিলেন। জিএসএফ জানিয়েছে, আগুনে জাহাজের মূল ডেক ও গুদামজাত করার স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলেও যাত্রীরা দ্রুত আগুন নিভিয়ে ফেলেন। জাহাজে থাকা সকল কর্মী ও অ্যাক্টিভিস্টরা নিরাপদে আছেন বলে জানানো হয়েছে।
৫০টিরও বেশি জাহাজের জোটের অংশ এই 'ফ্যামিলি বোট'। গাজায় ইসরায়েলের অবরোধ ভাঙার উদ্দেশ্যে গঠিত এই জোটে কমপক্ষে ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এটি ২৫ সালের ৩১ আগস্ট যাত্রা শুরু করে এবং পরে সিদি বু সাইদ বন্দরে অন্যান্য জাহাজের সাথে যোগ দেয়।
মঙ্গলবার গভীর রাতে দ্বিতীয়বারের মতো হামলা চালানো হয়। তিউনিসিয়ার জলসীমায় যুক্তরাজ্যের পতাকাবাহী 'আলমা' নামের আরেকটি ফ্লোটিলা জাহাজেও সন্দেহভাজন ইসরায়েলি ড্রোন হামলা চালানো হয়।জিএসএফ জানিয়েছে, এই হামলায় জাহাজের উপরের ডেক আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ইয়েমেন
ইসরায়েল বুধবার ইয়েমেনের রাজধানী সানায় বিমান হামলা চালিয়েছে, হুথি অবস্থানগুলোকে লক্ষ্য করে। হামলায় সানা বিমানবন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা এক মাসের মধ্যে ওই স্থানে দ্বিতীয়বারের মতো হামলা।
এর আগে ৬ মে ইসরায়েল বিমানবন্দরে আঘাত হানে, টার্মিনাল ভবন ধ্বংস করে এবং রানওয়ের মারাত্মক ক্ষতি করে।
২৫ সালের ২৮ আগস্ট ইসরায়েলি বিমান হামলায় সানায় হুথি সরকারের একটি বৈঠক লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। সেই হামলায় হুথি প্রধানমন্ত্রী আহমেদ আল-রাহাওয়ি এবং আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নিহত হন।