তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে দেরি হওয়ায় আসামিরা জামিন পেয়ে যাচ্ছে: আদালত

চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, ঢাকার থানাগুলো সময়মতো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করায় ছিনতাই-ডাকাতির মামলার আসামিরা জামিন পেয়ে যাচ্ছেন।
এই পর্যবেক্ষণ দিয়ে অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন সম্প্রতি মতিঝিল, পল্টন ও শাহজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে আদালতের এই পর্যবেক্ষণ সত্য নয় বলে মনে করছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, মামলার জটিলতা ও দৈনন্দিন কাজের চাপের কারণে তদন্তে সময় বেশি লাগে।
আদালতের আদেশে বলা হয়, পেনাল কোডের ৩৯২, ৩৯৩ ও ৩৯৪ ধারায় দায়ের হওয়া অধিকাংশ ছিনতাই মামলায় তিন থেকে ৬ মাস অতিক্রান্ত হলেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে না।
বিচারক উল্লেখ করেন, যেসব মামলায় আসামি হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়, আলামত উদ্ধার করা হয় এবং কোনো পলাতক আসামি থাকে না, সেসব মামলায় ১৫ দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন দাখিল করা সম্ভব।
কিন্তু অধিকাংশ মামলায় তিন থেকে পাঁচ মাসের মধ্যেও পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে না।
আদালতের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, আদালত থেকে লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হলেও অনেক সময় সংশ্লিষ্ট থানাগুলো তা যথাযথভাবে প্রতিপালন করে না।
ফৌজদারী কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ১৭৩বি ধারা অনুযায়ী ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলের বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করা হলেও তা মানা হচ্ছে না।
বিচারক মন্তব্য করেন, জামিন শুনানিকালে প্রায়ই দেখা যায়, ছিনতাই মামলার আসামিরা ৫ থেকে ৭ মাস হাজতে থাকার পরও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি এবং তদন্ত বিলম্বের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা কোনো প্রতিবেদন বা লিখিত ব্যাখ্যা দাখিল করেন না।
তিনি বলেন, এর ফলে হাজতি আসামিদের জামিন পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। একইসঙ্গে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্বের কারণে মামলাগুলোর বিচার ও নিষ্পত্তিতেও দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে।
পুলিশের বক্তব্য
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, এই বিলম্ব অনিবার্য।
এর কারণ হিসেবে তারা বলেন, আসামীরা অনেক সময়ই ভুল তথ্য দেন। অন্য জেলার থানার মাধ্যমে তাদের নাম-ঠিকানা যাচাই যাচাই করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ।
করতে সময় লাগে। এছাড়া এক একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে একাধিক মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকেন। তার ওপর রুটিন দায়িত্ব থাকে যার কারণে চাইলেও দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হয় না।
একজন উপ-পরিদর্শক (এসআই) টিবিএসকে বলেন, 'আমার কাছে অন্তত চারটি মামলা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলাও রয়েছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মামলায় আসামি কয়েক শত। ফলে ওই মামলায় ফোকাস দিতে গিয়ে ছিনতাই মামলায় তদন্ত করতে বিলম্ব হচ্ছে।''
গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশ বাহিনীতে চলমান সংস্কার ও বদলির কথা উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি )বলেন, 'আমাদের অনেক পুলিশ সদস্য ঢাকায় নতুন। এছাড়া এক একজন পুলিশ কর্মকর্তা একাধিক মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকেন। তার ওপর রুটিন দায়িত্ব থাকে। সব মিলিয়ে চাইলেও দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া সম্ভব হয় না।'
ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ও গ্রেপ্তার
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলার অবনতির মধ্যে ঢাকায় ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনা ব্যাপক বেড়ে যায়। বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাইকারীদের হাতে খুনের ঘটনাও ঘটেছে।
ছিনতাই ঠেকাতে ঢাকার অনেক পাড়া-মহল্লায় মানুষ রাত জেগে পাহারাও বসিয়েছিল।
পরে পুলিশি কার্যক্রম কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করলে ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানও শুরু হয়। পুলিশের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনীও অভিযান জোরদার করে। বিভিন্ন এলাকায় অনেক আসামি গ্রেপ্তার হতে থাকে।
ডিএমপি হেডকোয়ার্টার ও আদালতের রেকর্ড সূত্রে জানা যায়, মে, জুন ও জুলাই মাসে ঢাকা মহানগরীর ৫০টি থানায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় ২৪৫ মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয় ৮৩৩ জন আসামি। অন্যদিকে একই সময়ে জামিন পেয়েছেন চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেপ্তার ১ হাজার ১০৮ জন। এর মধ্যে মে মাসে ৪২৫ জন, জুনে ৩০৫ জন ও জুলাইয়ে ৩৭৮ জন আসামি জামিন পান।
এজাহারভুক্ত আসামিরাও জামিন পাচ্ছেন
প্রচলিত আইনে ছিনতাইয়ের ঘটনায় 'দস্যুতা' ও 'ডাকাতির' ধারায় মামলা হয়। আসামির সংখ্যা এক থেকে চারজন হলে দস্যুতা এবং চারজনের বেশি হলে তা ডাকাতি হিসেবে গণ্য হয়।
পুলিশ সূত্র বলছে, গত তিন মাসে যারা জামিন পেয়েছেন, তাদের একটি বড় অংশই ছিনতাইয়ের অভিযোগে করা মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট অপরাধ ও নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।
যেমন, শুধু জুলাইয়ে জামিন পাওয়া ৩৭৮ জনের মধ্যে ১৪৮ জনই এজাহারভুক্ত আসামি। তাদের ১৯৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সন্দেহভাজন হিসেবে। একজনের নাম এসেছিল তদন্তের সময়। বাকি ৩১ জনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি।
আগের মাসগুলোর পরিসংখ্যানেও একই চিত্র দেখা যায়। মে মাসে জামিন পাওয়া ৪২৫ জনের মধ্যে সন্দেহভাজন আসামি ২১৫ জন, এজাহারভুক্ত আসামি ১৩১ জন ও তদন্তে সম্পৃক্ততা পাওয়ার পর গ্রেপ্তার হন ১৬ জন। ৬৩ জনের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। জুনে জামিন পাওয়া ৩০৫ জনের মধ্যে ১৫০ জনই এজাহারভুক্ত আসামি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী সম্পাদক ইফতেখার আলম টিবিএসকে বলেন, 'জুলাই অভ্যুত্থানের পর পুলিশের মনোবল অনেক কমে গেছে। পুলিশকে ঢেলে সাজাতে হবে। উৎকর্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জনবল বাড়াতে হবে, যাতে করে তদন্তের জন্য বিচার বিলম্বিত না হয়।'