ক্রমবর্ধমান লক্ষ্যমাত্রা, থমকে থাকা সংস্কার: ২০২৬ অর্থবছরের রপ্তানি লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে বাংলাদেশ?

বছর বছর বাংলাদেশ বাংলাদেশ সরকার উচ্চাভিলাষী রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করে। আর রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা প্রতিবারই প্রশ্ন তোলেন, বছরের পর বছর ধরে চলে আসা পুরনো চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান না করে সেই লক্ষ্য কীভাবে অর্জন করা সম্ভব?
মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য পণ্য ও সেবা খাত থেকে ৬৩.৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে—যা গত বছরের লক্ষ্যের চেয়ে ১৬.৫ শতাংশ বেশি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রপ্তানি আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮.৫ শতাংশ বাড়লেও সেটি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭.৫ শতাংশ কম ছিল।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা সরকার নির্ধারণ করে, তা সঠিক কোনো গবেষণার মাধ্যমে হয় না। এসব লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত রোডম্যাপের চেয়ে বরং রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই বেশি কাজ করে। রপ্তানিকারকরা বলছেন, প্রতি বছর যেটুকু প্রবৃদ্ধি হয়, তা মূলত তাদের প্রচেষ্টার কারণে। বছর বছর ধরে যেসব কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা তারা মোকাবিলা করে আসছেন, তা সমাধানের সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা দেখা যায় না।

বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'রপ্তানি উৎসাহিত করতে দেওয়া বিভিন্ন প্রণোদনা কমানো হয়েছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বের হয়ে গেলে প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব না হলে বিকল্প কী উপায়ে রপ্তানিকারকদের সহায়তা দেওয়া যায়, তা নিয়েও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।'
জ্বালানি সংকট, ব্যাংকিং খাতের জটিলতা, কাস্টমসে বিলম্ব, বন্দর জট, পরিবহন সমস্যা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করেন হাতেম। তিনি আরও বলেন, ছোট রপ্তানিকারকদের জন্য কাঁচামালের আমদানি সহজ করতে দীর্ঘদিন ধরে সেন্ট্রাল বন্ডেড ওয়্যারহাউসের কথা বলা হলেও এক দশকেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
লক্ষ্যমাত্রা বনাম বাস্তবতা
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, বাণিজ্য দক্ষতা, বহুমুখীকরণ ও বাজার সম্প্রসারণে উন্নতি না হলে 'শুধু রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেওয়া অর্থহীন'। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমাসহ চার থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি রপ্তানি কৌশল প্রণয়নের আহ্বান জানান তিনি।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতিটি খাতের এক বা দুটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত ও সমাধানের জন্য মন্ত্রণালয় আগামী সপ্তাহ থেকে শিল্প নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শুরু করবে।
দীর্ঘদিনের প্রতিবন্ধকতা
রপ্তানিকারকরা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গ্যাস সংকট ও তীব্র বন্দর জটের কথা তুলে ধরেন। বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোতে পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে মালামাল খালাস করার জন্য তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এজন্য প্রতিটি ট্রাককে দৈনিক ৩ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হয়।
চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কিছু রপ্তানিকারক ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্রের (এলসি) লিমিটের কারণে নতুন অর্ডার নিতে পারছেন না। অর্ধেকের বেশি রপ্তানিকারক এখন এই সমস্যা মোকাবিলা করছেন বলে উল্লেখ করেন হাতেম।
রপ্তানির অর্থ পরিশোধে বিলম্ব আরও বাধা সৃষ্টি করে। অর্থ আসতে দেরি হলেই—যা মূলত রপ্তানিকারকদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না—কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিজনেস আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (বিআইএন) ব্লক করে দেয়, যার কারণে তাদের পরবর্তী রপ্তানি চালান পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়।
কাস্টমসে অদক্ষতাও কার্যক্রমকে ব্যাহত করে চলেছে। রপ্তানিকারকরা জানান, এইচএস কোডে সামান্য ভুল হওয়ার কারণেও ২০০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা এবং কাঁচামাল উৎপাদনে নিতে দীর্ঘ বিলম্বের শিকার হতে হয়।
রপ্তানি বহুমুখীকরণ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে আলোচনা চললেও পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতা উল্টো আরও বেড়েছে। গত অর্থবছরে মোট রপ্তানিতে রপ্তানি আয়ে এ খাতের অবদান ৮০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৮৫ শতাংশ হয়েছে।
বৈশ্বিক প্রতিকূলতা
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বর্তমান বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতি বিবেচনায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রাকে 'অত্যন্ত উচ্চাভিলাষী' বলে উল্লেখ করেন।
তিনি সতর্ক করে বলেন, মার্কিন শুল্ক পরিবর্তনের কারণে কিছু অর্ডার বাংলাদেশের দিকে আসতে পারে, তবে সেগুলো সম্ভবত কম দামে আসবে। অন্যদিকে অন্যান্য রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের দিকে পাঠানোর কারণে সেখানে প্রতিযোগিতা তীব্র হবে, যা দাম আরও কমিয়ে দেবে।
তিনি আরও বলেন, ভারতে রপ্তানির জন্য স্থলবন্দরের ব্যবহার কমে যাওয়া এবং ভারতের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য চুক্তির ফলে তাৎক্ষণিক শুল্ক সুবিধা পাওয়ায় ব্রিটিশ বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
শর্তসাপেক্ষ আশাবাদ
প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শিল্প নেতারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ বাধাগুলো সমাধান করা হলে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, অনেক কারখানা সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদনে চলছে। তিনি বলেন, 'যদি গ্যাস সংকট, ব্যাংকিং খাতের অস্থিতিশীলতা, কাস্টমসের অদক্ষতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়, তবে আমরা সরকারের লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যেতে পারব।'
হাতেমও একই সুরে বলেন, 'এসব সমস্যা সমাধান করতে পারলে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি রপ্তানি করা সম্ভব হবে।'