হান্স অ্যান্ডারসনের রূপকথার সঙ্গে ভালোবাসা ও ঘৃণার যে সম্পর্ক !

সাত বছর বয়সে আমি এক অপ্রত্যাশিত ও লজ্জাজনক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলাম। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন একদিন ক্লাসরুমে বসে যোগ-বিয়োগ শিখছিলাম। ঠিক তখনই আমি নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কান্নাটা আর শব্দহীন রইল না। শত চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারিনি।
পুরো ক্লাসরুম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল; কেউ বিস্মিত, কেউ বিভ্রান্ত, কেউ বা হয়তো মজা পাচ্ছিল। তখন শিক্ষিকা মিসেস লিপটন আদর করে আমাকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে নিয়ে গেলেন। তিনি জানতে চাইলেন, হঠাৎ কী হয়েছে আমার।
কিন্তু আমি তখন এতটাই আবেগে ভেঙে পড়েছিলাম, এতটাই অপমানিত বোধ করছিলাম, যে কোনো কথা বলতে পারিনি। পরে, দুপুরে খাবার সময় তিনি কৌশলে আবার জানতে চাইলেন, 'বাসায় কিছু ঘটেছে?' আমি শুধু মাথা নেড়ে 'হ্যাঁ' বলেছিলাম।
আমার সেই হঠাৎ কান্নার কারণ ছিল একটি ছোট মেয়ের গল্প, যা আগের রাতে মা আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন—হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের লেখা 'দ্য লিটল ম্যাচ গার্ল'।
ক্লাসরুমে বসে আমি বারবার ভাবছিলাম সেই একাকী মেয়েটির কথা, যে তার হাতে থাকা শেষ ম্যাচগুলো জ্বালিয়ে শরীর উষ্ণ রাখার চেষ্টা করছিল আর স্মরণ করছিল মৃত দাদির মুখ। ধীরে ধীরে সে হারিয়ে যায় কল্পনার জগতে। শেষ পর্যন্ত, বাস্তব আর কল্পনার সীমানা মুছে গিয়ে, বছরের প্রথম দিনের ভোরে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের রাস্তায় জমে যাওয়া তার নিথর দেহ খুঁজে পাওয়া যায়।
১৯৭৬ সালে ব্রুনো বেটেলহেইম হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের গল্প নিয়ে লিখেছিলেন, 'একটি শিশু সহজেই অনুভব করতে পারে, এই গল্পগুলো অবাস্তব, কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক নয়।' লোককাহিনি সংগ্রহের বদলে অ্যান্ডারসেন মূলত নিজের মৌলিক কল্পনার জগৎ থেকেই লিখতেন। তার ৯ খণ্ডে সংকলিত ১৫৬টি গল্প এতটাই গভীর ও প্রভাবশালী যে তা শিশুদের মনে স্থায়ী ছাপ ফেলে। পরবর্তীতে সেগুলো রূপকথার গল্প হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
১৫০ বছর আগে, আগস্ট মাসের ৪ তারিখে, মৃত্যুবরণ করেন হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন। জীবদ্দশায় তিনি ব্যাপক বাণিজ্যিক সাফল্য পেয়েছিলেন, তবে তার ব্যক্তিজীবন ছিল নিঃসঙ্গতা ও অপূর্ণতায় ভরা।
এক সময় অ্যান্ডারসন ও চার্লস ডিকেন্সের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, কিন্তু পরে সেই সম্পর্কেও ফাটল ধরে। এসব অভিজ্ঞতা হয়তো তার গল্পগুলোর অন্ধকার ও বিষাদময় আবহের পেছনে প্রভাব ফেলেছিল।
তবে অ্যান্ডারসেনর লেখা সব গল্পই যে দুঃখভারাক্রান্ত, তা নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় 'দ্য প্রিন্সেস অ্যান্ড দ্য পি'। এই গল্পের শেষটা ছিল আনন্দময় এবং সবার মঙ্গলজনক। এমন আরও অনেক গল্প আছে, যেগুলোর সমাপ্তি বেশ আশা জাগানিয়া।
তবু, 'দ্য লিটল ম্যাচ গার্ল' আজও এক অনন্য ও চিরন্তন গল্প হিসেবে টিকে আছে। আমার এক সহকর্মী, লিজ, একবার একে আখ্যা দিয়েছিলেন 'প্রতিটি শিশুর সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন' হিসেবে। আমারও মনে পড়ে, বয়স যখন বিশ, আমি একটি দোকানে কাজ করতাম। এক সহকর্মী হঠাৎ প্রশ্ন করেছিলেন, 'তুমি কি কখনো হঠাৎ করে "দ্য লিটল ম্যাচ গার্ল"-এর কথা ভাবতে শুরু করো?' আমি বলেছিলাম, 'হ্যাঁ।'
এর কয়েক বছর পর, ব্রুকলিনের এক বারে, ভিনদেশে বড় হওয়া এক বন্ধুর সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। হঠাৎ তার চোখেমুখে বিষণ্নতার ছাপ দেখলাম। কারণ জানতে চাইলে সে বলেছিল, 'আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখজনক গল্পটার কথা ভাবছি।' আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'দ্য লিটল ম্যাচ গার্ল?' সে মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছিল।
ব্যক্তিগতভাবে আমি চাই, আমার ছেলেকে এসব গল্প পড়ে শোনাতে। কারণ এই গল্পগুলো আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু একইসঙ্গে ভয় হয়, এই রকম হৃদয়বিদারক, নিঃসঙ্গতা ও মৃত্যুর উপস্থাপনায় পূর্ণ গল্প শুনে সে মানসিকভাবে আঘাত পাবে না তো?
অথচ মজার বিষয় হলো, সে ইতোমধ্যে সেন্ট্রাল পার্কে স্থাপিত হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসনের ভাস্কর্য নিয়ে কঠিন কিছু প্রশ্ন করতে শুরু করেছে।
আমি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করি, হান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন ছিলেন এক অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী। শুধু তার কল্পনাশক্তির জন্য নয় বরং তিনি শিশুদের মনস্তত্ত্ব গভীরভাবে বুঝতেন এবং সে অনুযায়ী গল্প বলতেন। তার লেখাগুলো শিশুদের মনে এমন গভীর ছাপ ফেলত যে, মনে হতো যেন এগুলো হাজার বছরের পুরনো কোনো লোককাহিনি।
কয়েক বছর আগে আমি প্রথমবারের মতো ডেনমার্ক যাওয়ার সুযোগ পাই। কোপেনহেগেনের টিভোলি গার্ডেনের পাশে অ্যান্ডারসনের একটি বিশাল ব্রোঞ্জের মূর্তি রয়েছে। এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে সেখানে দাঁড়িয়ে আমি হাসিমুখে মূর্তির গায়ে হেলান দিয়ে ছবিও তুলেছিলাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে আমার মনে বাজছিল 'দ্য লিটল ম্যাচ গার্ল'-এর সেই হৃদয়বিদারক বাক্যটি:
'হঠাৎ সে দেখল একটা তারা খসে পড়ছে, আর তার পেছনে উজ্জ্বল আগুনের রেখা দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট মেয়েটি ভাবলো, 'কেউ একজন মারা গেল,' কারণ তারমৃত দাদি বলেছিলেন, যখন কোনো তারা খসে পড়ে, তখন একটা আত্মা সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যায়।'