অরুন্ধতী রায়ের ‘আজাদি’সহ ২৫ বই নিষিদ্ধ ঘোষণা কাশ্মীরে
ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মীরে বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক ও মানবাধিকারকর্মী অরুন্ধতী রায়ের বইসহ ২৫টি বই নিষিদ্ধ করেছে ভারত সরকার। এসব বই কাশ্মীর সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদকে উসকে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করা হয়।
এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন জম্মু ও কাশ্মীরের লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনোজ সিনহা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকারের মনোনীত এই কর্মকর্তা এর আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
সিনহার নির্দেশে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, 'সরকারের নজরে এসেছে, কিছু বই কাশ্মীর বিষয়ে ভ্রান্ত তথ্য প্রচার করছে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব উসকে দিচ্ছে।'
নিষিদ্ধ ঘোষিত ২৫টি বইয়ের মধ্যে রয়েছে দেশি-বিদেশি লেখকদের ইতিহাসভিত্তিক বই, যেখানে কাশ্মীরের রাজনৈতিক বাস্তবতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সহিংসতার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। এসব লেখকের মধ্যে রয়েছেন খ্যাতিমান সাংবাদিক, ইতিহাসবিদ ও গবেষক।
জম্মু ও কাশ্মীরকে বিশ্বের অন্যতম সামরিকভাবে নিয়ন্ত্রিত এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধে লিপ্ত, এবং এর বিভিন্ন অংশ দুই দেশই নিয়ন্ত্রণ করে।
নব্বইয়ের দশক থেকে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে চলছে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। এই আন্দোলন দমনে ভারতীয় বাহিনীর দীর্ঘদিনের অভিযানে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমনসহ নানা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। যদিও ভারত সরকার এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছে।
নিষিদ্ধ বইগুলোর মধ্যে রয়েছে অরুন্ধতী রায়ের 'আজাদি'। বইটিতে কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর হাতে নিহত ও গুম হওয়া হাজার হাজার মানুষের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে। এ ছাড়া রয়েছে অস্ট্রেলীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিস্টোফার স্নেডেনের 'ইন্ডিপেনডেন্ট কাশ্মীর', যেখানে কাশ্মীরের স্বাধীনতার সংগ্রাম বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
নিষিদ্ধ অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শিক্ষাবিদ হাফসা কানজওয়ালের 'কলোনাইজিং কাশ্মীর: স্টেট-বিল্ডিং আন্ডার ইন্ডিয়ান অকুপেশন' এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক সুমন্ত্র বোসের 'কনটেস্টেড ল্যান্ডস: ইসরায়েল-প্যালেস্টাইন, কাশ্মীর, বসনিয়া, সাইপ্রাস অ্যান্ড শ্রীলঙ্কা'।
সরকার দাবি করেছে, এসব বই 'সন্ত্রাসবাদকে গৌরবান্বিত' করেছে, ইতিহাস বিকৃত করেছে এবং সহিংসতাকে উসকে দিয়েছে। এছাড়া এসব বই কাশ্মীরি তরুণদের চরমপন্থায় প্ররোচিত করছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে।
নিষিদ্ধ বইয়ের লেখকরা এ ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, তারা যে অঞ্চল নিয়ে লেখালেখি করেছেন, সেখানেই তাদের বই নিষিদ্ধ করা হয়েছে যেটি দুঃখজনক।
'কাশ্মীর: দ্য কেস ফর ফ্রিডম' বইয়ের সহ-লেখক ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায় বলেন, 'এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে গবেষণাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করার এবং সেটিকে রাষ্ট্রবিরোধী প্রোপাগান্ডা হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।'
অঙ্গনা আরও বলেন, 'এই নিষেধাজ্ঞার প্রতীকী ও বাস্তব প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। এটি কাশ্মীরিদের ভয় দেখানোর এবং তাদের কষ্ট ও প্রতিরোধকে স্তব্ধ করার জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক চেষ্টা।'
অঙ্গনা অভিযোগ করেন, 'এই আদেশ ভারত সরকারের বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ, যার উদ্দেশ্য হলো কাশ্মীরে দীর্ঘদিন ধরে চলা রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, দমননীতি ও দায়মুক্তির ইতিহাসকে মুছে ফেলা। এতে বোঝা যায়, সরকার সমালোচনাকে ভয় পায় এবং মুক্তচিন্তাকে সহ্য করতে চায় না।'
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে মোদি সরকার জম্মু ও কাশ্মীরের বহুদিনের স্বায়ত্তশাসন ও রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করে, অঞ্চলটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এরপর থেকেই সেখানে মতপ্রকাশ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর দমনপীড়নের অভিযোগ ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মীরের বিভিন্ন বইয়ের দোকানে অভিযান চালায় পুলিশ। সে সময় ৬৫০টিরও বেশি বই জব্দ করা হয়। বইগুলো নিষিদ্ধ মতাদর্শ প্রচার করছে বলে অভিযোগ তোলে কর্তৃপক্ষ।
