বিদেশি ঋণের প্রকল্পে বিলম্ব ও অপচয় রোধে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের আগে ৬ শর্ত দেবে সরকার

বিদেশি ঋণের উন্নয়ন প্রকল্পের সময়মতো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে ও অনাবশ্যক ব্যয় রোধে ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের আগে ছয়টি পূর্বশর্ত পূরণ বাধ্যতামূলক করতে যাচ্ছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। এসব বাধ্যতামূলক শর্তের মধ্যে রয়েছে প্রকল্প অনুমোদনের আগে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা, দরপত্র প্রক্রিয়া চূড়ান্ত ও প্রকল্পসংশ্লিষ্ট জনবল নিয়োগ সম্পন্ন করা।
এসব শর্ত সংবলিত একটি পরিপত্রের খসড়া ইতিমধ্যে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।
ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, 'টাইম ভ্যালু অভ মানি' বা সময়ানুগ অর্থমূল্য নিশ্চিতকরণ ও অব্যবহৃত তহবিলের জন্য ধার্য কমিটমেন্ট চার্জসহ অন্যান্য অনাকাঙ্ক্ষিত অতিরিক্ত ব্যয় এড়াতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতেই এই পরিপত্র তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইআরডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এই শর্তাবলি কেবল নতুন প্রকল্পেই নয়, বরং যেসব প্রকল্প বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন বা পাইপলাইনে রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
'এজন্য প্রাথমিক প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব (পিডিপিপি) প্রণয়ন পর্ব থেকেই উদ্যোগী মন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থাকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে,' বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে বৈদেশিক সহায়তা আরও কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হবে। পাশাপাশি অনাকাঙ্ক্ষিত বিলম্ব ও ব্যয় এড়ানোও সম্ভব হবে। এ পদক্ষেপ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সময়োপযোগী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, উন্নয়ন প্রকল্পের অনেক রুটিন বা প্রস্তুতিমূলক কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্প শুরুর আগেই সম্পন্ন করা সম্ভব এবং উচিত।
'উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে সমস্ত প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করাই প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বিলম্ব এড়ানোর মূল চাবিকাঠি। তবে এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন,' বলেন তিনি।
ড. মুজেরী আরও বলেন, বাংলাদেশে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প সময়মতো শেষ না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো দুর্নীতি।
'অনেক সময় কর্মকর্তারা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বাস্তবায়নে বিলম্ব করেন, যা প্রকল্পের ব্যয় বাড়ায় এবং দুর্নীতির সুযোগ তৈরি করে।'
ছয় পূর্বশর্ত
খসড়া পরিপত্র অনুযায়ী, বিদেশি ঋণের প্রকল্পের জন্য কোনো ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে ছয়টি প্রধান শর্ত পূরণ করতে হবে।
প্রথম শর্ত হলো, পরিকল্পনা কমিশনের স্তরবিন্যাস অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের দ্বারা প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) বা টিএপিপি (টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রজেক্ট প্রপোজাল) অনুমোদন নিশ্চিত করা।
দ্বিতীয়ত, প্রকল্প পরিচালকসহ প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ সম্পন্ন করতে হবে, যাতে প্রকল্প কার্যক্রম দ্রুত শুরু করা সম্ভব হয়।
তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের অধীনস্থ সংস্থা কর্তৃক প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করতে হবে।
চতুর্থ শর্ত অনুযায়ী, ভূমি অধিগ্রহণজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা তৈরি করে তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করতে হবে।
পঞ্চম শর্তে বলা হয়েছে, পণ্য, পূর্ত ও সেবা-সংক্রান্ত ব্যয় প্রাক্কলন, দরপত্র নথি প্রস্তুত ও কন্ট্রাক্ট অ্যাওয়ার্ড পর্যন্ত সম্পূর্ণ দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।
ষষ্ঠ শর্ত অনুসারে, প্রকল্প বাস্তবায়নে ইউটিলিটি স্থানান্তরের প্রয়োজন হলে সংশ্লিষ্ট সেবাদাতা সংস্থা ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার মধ্যে একটি সময়াবদ্ধ সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করতে হবে। একইসঙ্গে সাবসিডিয়ারি ঋণচুক্তির (এসএলএ) শর্তাবলির ব্যাপারে অর্থ বিভাগের সম্মতি নিশ্চিত করতে হবে।
যেভাবে বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধির কবলে বিদেশি ঋণের প্রকল্প
ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্বল প্রস্তুতি ও বাস্তবায়নগত জটিলতার কারণে বাংলাদেশের বেশিরভাগ বিদেশি ঋণের উন্নয়ন প্রকল্পে বড় ধরনের বিলম্ব ও ব্যয়বৃদ্ধি ঘটে।
তারা বলেন, অনেক বাস্তবায়নের কাজ শেষ হওয়ার আগেই ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যায়। ফলে প্রকল্প থেকে সুফলও নির্ধারিত সময়ে পাওয়া যায় না। পাশাপাশি অতিরিক্ত খরচও বহন করতে হয়। উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণ সময়মতো ব্যবহার করতে না পারায় প্রায়ই সরকারকে কমিটমেন্ট ফি দিতে হয়।
এর একটি বড় উদাহরণ হলো এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে ঢাকা-সিলেট চার লেন মহাসড়ক প্রকল্প। চার বছর ধরে নির্মাণকাজ চললেও এর ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৪.৫৫ শতাংশ।
ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, মোট ২০৯.৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই মহাসড়কের ১৯২.৩২ কিলোমিটারের কাজ আটকে আছে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায়। এ পর্যন্ত মাত্র ১৭ কিলোমিটার অংশে কাজ চলছে।
প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বিলম্বের কারণে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এর বর্তমান প্রাক্কলিত ব্যয় ১৯ হাজার ৯১৮.৫৯ কোটি টাকা।
একই ধরনের বাধার মুখে পড়া আরেকটি প্রকল্প হলো বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সিলেট-চারখাই-শেওলা মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প। ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, এ প্রকল্প ২০২৩ সালে বাস্তবায়নে গেলেও এখনও দরপত্র প্রণয়নের কাজ শেষ করা যায়নি।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পে তিনজন উপ-প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও দুইজন সহকারী প্রকৌশলীর পদ রয়েছে। কিন্ত এসব পদে এখনও পর্যন্ত কোনো কর্মকর্তাই পদায়িত হননি। এতে ভূমি অধিগ্রহণ, ইউটিলিটি অপসারণসহ মাঠ পর্যায়ের নানাবিধ প্রয়োজনীয় কাজ ত্বরান্বিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) অর্থায়নে সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পে তিনটি পূর্ত প্যাকেজের ঠিকাদারে সঙ্গে এর চুক্তি সই হলেও প্রয়োজনীয় ভূমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম এখনও সম্পন্ন হয়নি।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০২০ সালে শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এই প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি মাত্র ৭.৯৪ শতাংশ।
মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট চার্জ দিচ্ছে বাংলাদেশ
ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, বিদেশি ঋণ সময়মতো ব্যয় করতে না পারার কারণে বাংলাদেশকে প্রতি বছর মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট চার্জ হিসেবে পরিশোধ করতে হচ্ছে।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত এডিবির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অর্ডিনারি ক্যাপিটাল রিসোর্স (ওসিআর) ঋণের ছাড় না করা সমস্ত অর্থের ওপর বার্ষিক ০.১৫ শতাংশ হারে কমিটমেন্ট চার্জ আরোপ করা হয়। এই চার্জ ঋণ স্বাক্ষরের ৬০ দিন পর থেকে শুরু হয় এবং ঋণ কার্যকর হওয়ার তারিখ থেকে গণনা করা হয়।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বর্তমানে বাংলাদেশের পোর্টফোলিওতে থাকা মোট ৭.০৭ বিলিয়ন ডলারের ওসিআর বিনিয়োগ ঋণের মধ্যে ২.৩৯ বিলিয়ন ডলার এখনও ছাড় হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশকে এখন পর্যন্ত ক্রমবর্ধমানভাবে ৩০.৮৯ মিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে।
শুধু ২০২৪ সালেই অব্যবহৃত এডিবি ঋণের ওপর বাংলাদেশকে ৩.৫৮ মিলিয়ন ডলার কমিটমেন্ট ফি দিতে হয়েছে।