জাপানি ঋণের সুদহার রেকর্ড ২ শতাংশে, তারপরও অন্যদের চেয়ে তুলনামূলক সহনীয়

প্রথমবারের মতো জাপানি ঋণের জন্য ২ শতাংশ হারে সুদ দেবে বাংলাদেশ, বিশেষত জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েল গেজ রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প ঋণের ক্ষেত্রে এই হার প্রযোজ্য হবে। বাংলাদেশের জন্য জাপানের ঋণে এটাই সর্বোচ্চ সুদহার, যা এর আগে কখনো ছিল না।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, গত ২৭ জুন সই হওয়া চুক্তির আওতায়, এ প্রকল্পের জন্য জাপান থেকে ৬৩ কোটি ডলার (৬৩০ মিলিয়ন) অর্থায়ন নিশ্চিত হয়েছে।
এর আগে, বাংলাদেশের জন্য জাপানি ঋণ বরাবরই স্বল্পসুদে পাওয়া যেত এবং তা অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত-ও ছিল। তবে ইআরডি কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাপানি ঋণের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। শুধু নির্মাণ প্রকল্প নয়, একই প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে নেওয়া ঋণের সুদহারও বেড়ে ০.৬৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
জাপানি অর্থায়নের চিত্র বদলাচ্ছে
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, জাপানি ঋণের সুদহার বৃদ্ধির একটি স্পষ্ট ধারা তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের (২০২৫-২৬) শুরুতে, অর্থাৎ গত নভেম্বর মাসে নেওয়া প্রথম জাপানি ঋণের সুদহার ছিল ১.৭ শতাংশ। এরপর তা পর্যায়ক্রমে বেড়ে দাঁড়ায় ১.৮৫, ১.৯৫ এবং সর্বশেষ চুক্তিতে ২ শতাংশে পৌঁছেছে।
ফলে জাপানি ঋণের সুদহার এখন অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে চলে এসেছে। অথচ ২০২২ সাল পর্যন্ত জাপানি ঋণের সুদহার ছিল ১ শতাংশের নিচে।
বাংলাদেশে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)-এর প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুছি তমুহিদে বলেন, "বিশ্বব্যাপী সংগ্রহ ব্যয় ও মূল্যস্ফীতির প্রবণতার ভিত্তিতে, প্রতি ছয় মাস পরপর ঋণের সুদহার পর্যালোচনা করা হয়। সুদহার কিছুটা বেড়ে গেলেও বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হওয়ায়—জাইকা এখনো অত্যন্ত সহায়ক ও সুবিধাজনক শর্তে ঋণ প্রদান করছে।"
ইআরডি জানায়, প্রতিবছরের এপ্রিল ও অক্টোবরে জাপান তাদের ঋণের সুদহার পর্যালোচনা করে, যেখানে ঋণগ্রহীতা দেশের মোট জাতীয় আয় (জিএনআই) এবং জাপানের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়। যদিও সাম্প্রতিক প্রবণতা ঊর্ধ্বমুখী, তারপরও কখনো কখনো সুদহার কমেছে, যেমন ২০২৩ সালের অক্টোবরে মাতারবাড়ী আলট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঋণের সুদহার ছিল ১.৬ শতাংশ; এবং ডিসেম্বরে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ প্রকল্পের ঋণের সুদহার ছিল মাত্র ১.৩ শতাংশ।
তবুও তুলনামূলক সাশ্রয়ী
সুদহার বাড়লেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জাপানি ঋণ এখনো অত্যন্ত আকর্ষণীয়, কারণ অন্যান্য শর্ত এতটাই সুবিধাজনক যে তুলনামূলকভাবে এগুলো সস্তা। বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, "২ শতাংশ সুদহারের পরও জাপানি ঋণ অনেক বিকল্পের তুলনায় সস্তা, কারণ তাদের শর্তাগুলো অনেকটা অনুকূল।"
ইআরডির তথ্যমতে, জাপানের ঋণে ১০ বছর গ্রেস পিরিয়ড (ঋণ পরিশোধে অবকাশকাল) এবং ৩০ বছরের পরিশোধ মেয়াদ রয়েছে, যা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের তুলনায় অনেক বেশি।
উদাহরণস্বরূপ, বিশ্বব্যাংকের রেয়াতি বা স্বল্প সুদের ঋণ, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর, তার সুদহার ১.৫ শতাংশের সঙ্গে ০.৭৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ যোগ হয়। এই ঋণের মেয়াদ ২৫ বছর, গ্রেস পিরিয়ড মাত্র ৫ বছর।
একইভাবে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) রেয়াতি ঋণে ২ শতাংশ সুদ নিলেও পরিশোধের শর্ত জাপানের মতো নমনীয় নয়। আর চীনের সরকারি রেয়াতি ঋণের (জিসিএল) সুদহার ২ শতাংশের কাছাকাছি হলেও—এর মেয়াদ মাত্র ১৫ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ৫ বছর, যা তুলনামূলকভাবে কঠিন।
পরামর্শক খরচও বাড়ছে
এছাড়া জাপানের অর্থায়নের প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে নেওয়া ঋণের সুদহারও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে এ ধরনের ঋণের সুদহার ০.৪০, ০.৫৫ এবং সর্বশেষ ০.৬৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে; যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল মাত্র ০.১ থেকে ০.২ শতাংশ।
জাপানি অর্থায়নের প্রকল্পগুলোতে সাধারণত জাপানি পরামর্শক নিয়োগ বাধ্যতামূলক থাকে।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, জাপানি অর্থায়নের প্রকল্পের ঋণ সাধারণত একাধিক কিস্তিতে ছাড়া হয়, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর সুদহারও বেড়ে যায়। এর একটি বাস্তব উদাহরণ মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের সপ্তম কিস্তি, যা ২০২৪ সালের মার্চে ছাড়া হয়েছে, সেখানে সুদহার ১.৯৫ শতাংশ; অথচ ২০২১ সালের নভেম্বরে চুক্তি হওয়া পঞ্চম কিস্তির সুদহার ছিল মাত্র ০.৬৫ শতাংশ।
এখন পর্যন্ত জাপান বাংলাদেশে মোট ৩৩.৬২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ ও অনুদান দিয়েছে। যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন, গ্রামীণ উন্নয়ন, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রকল্পে এসব অর্থ ব্যবহৃত হয়েছে।
ইআরডি আরও জানায়, বাংলাদেশের জন্য বেশকিছু জাপানি ঋণ মওকুফের ঐতিহাসিক উদাহরণও আছে, যা এই ঋণগুলোকে আলাদা গুরুত্বের অবস্থানে নিয়ে গেছে।