ফাঁকির একটি পথ বন্ধ: বিদেশি ঋণে খেলাপি হলে দেশেও ঋণ পাবে না কোম্পানিগুলো

বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ প্রাইভেট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এখন থেকে যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি ঋণে খেলাপি করবে, তাদের নাম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো (সিআইবি) ডেটাবেজে যুক্ত করা হবে।
বৈদেশিক ঋণে খেলাপি কমানো ও বাহ্যিক ঋণ ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুরুত্বপূর্ণ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্ক্রটিনি কমিটি অন ফরেন লোন অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট কমিটি (বৈদেশিক ঋণ ও সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট যাচাই কমিটি)।
এই পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি দীর্ঘদিনের ফাঁকফোকর বন্ধ করা হলো। এতদিন পর্যন্ত কেবল দেশীয় ঋণে খেলাপিদের তথ্য সিআইবি-তে সংরক্ষিত থাকত। ফলে বিদেশি ঋণে খেলাপি করলেও কোনো তথ্য না থাকায়, সেই প্রতিষ্ঠানগুলো আবারও স্থানীয় ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সহজেই নতুন ঋণ নিতে পারত।
কমিটির প্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে গত ২১ মে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে এর যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়: "বৈদেশিক ঋণ ঝুঁকি নিরুপণ ও খেলাপি হ্রাসে কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি এখন থেকে বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণ ও সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, যাতে কোনো রেসিডেন্ট প্রতিষ্ঠান বিদেশি ঋণে খেলাপি করেও স্থানীয় উৎস থেকে আর কোনো সুবিধা নিতে না পারে।"
'নিঃসন্দেহে ভালো'- প্রশংসা বিশেষজ্ঞদের
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন এই উদ্যোগকে "নিঃসন্দেহে একটি ভালো পদক্ষেপ" হিসেবে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, বৈদেশিক ঋণ ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য এ ধরনের তথ্য থাকা অত্যন্ত জরুরি। বিদেশি ঋণে খেলাপি করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থানীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ না দেওয়ার সিদ্ধান্তটিকে তিনি "যুক্তিসংগত" বলে মন্তব্য করেন। বিদেশ থেকে নেওয়া বেসরকারিখাতের ঋণের খেলাপির তথ্য এতদিন কেন সিআইবি'র ডাটাবেজে রাখা হয়নি, সেটি বড় প্রশ্ন বলে মনে করেন ফাহমিদা খাতুন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা, যিনি স্ক্রুটিনি কমিটির ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন, বৈদেশিক ঋণে কোনো প্রতিষ্ঠান খেলাপি হলে—সেক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরেন। টিবিএসকে তিনি বলেন, "বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার পর কোন কোম্পানি তা পরিশোধ না করলে সরকারের কিছুই করণীয় নেই। তা সত্বেও ঋণগ্রহীতারা যাতে বিদেশ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হয়, সেজন্যই তাদের খেলাপির তথ্য সিআইবিতে সংরক্ষণ করে অভ্যন্তরীণ ঋণ পাওয়ার সুযোগ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।"
ডলারের দর বৃদ্ধি ও ঋণ পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ
স্ক্রটিনি কমিটির সভায় ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড এর ২০ মিলিয়ন এবং থিয়েটার মেডিকেল বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডের ০.২০ মিলিয়ন ডলারের— মোট ২০.২০ মিলিয়ন ডলারের নতুন ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া ৯টি কোম্পানির প্রায় ৯৮৮ মিলিয়ন ডলারের পুরনো ঋণের রিপেমেন্ট সিডিউলসহ ফি ও চার্জ পরিবর্তনের প্রস্তাব, এবং ১৩টি কোম্পানির ৩১৫.০৭ মিলিয়ন ডলার ঋণের ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দিয়েছে কমিটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ঋণগ্রহীতা কোম্পানিগুলো সময়মত ঋণ পরিশোধ করতে না পারার কারণে পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়ে নিচ্ছে। এক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতাকে এককালীন কিছু বাড়তি চার্জ বা ফি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লাইবর (লন্ডন ইন্টার-ব্যাংক অফার্ড রেট) রেটের পরিবর্তে সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট) কার্যকর হওয়ার কারণে বিভিন্ন ঋণের ক্ষেত্রে চার্জ ও ফি'তে পরিবর্তন আসছে বলে জানান তিনি। এজন্য কমিটির অনুমোদন লাগছে।
স্ক্রটিনি কমিটির সভার কার্যবিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সভায় ২৪টি প্রস্তাব অনুমোদন পেলেও এর মধ্যে নতুন ঋণের প্রস্তাব মাত্র দু'টি। বাকি অধিকাংশই ছিল বিদ্যমান ঋণের পুনর্গঠন সংক্রান্ত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, 'এটা হতে পারে যে, আগে অনুমোদন করা ঋণগুলো পুনর্গঠনের প্রস্তাবগুলো কমিটি অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। তাছাড়া, বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট থাকার কারণে গত এক-দেড় বছর ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলো সময়মতো কিস্তি পরিশোধ করতে পারেনি। এর প্রেক্ষিতে ঋণ পরিশোধের সময়-সীমা পরিবর্তন আনাসহ চার্জ ও ফি পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে।'
কোম্পানিগুলোর নেওয়া বিদেশি ঋণ পুনর্গঠন (রিস্ট্রাকচারিং) করার বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)- এর সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল আউয়াল মিন্টু টিবিএসকে বলেন, "যখন বিদেশ থেকে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে, তখন ডলার রেট ছিল ৮৩-৮৪ টাকা, এখন ১২৩-১২৪ টাকা। অর্থাৎ, একই পরিমাণ কিস্তি দিতে ব্যবসায়ীদের এখন অনেক বেশি টাকার দরকার হচ্ছে।"
তিনি বলেন, চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার পাশাপাশি গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের কারণে কোন কোম্পানির পক্ষে এই মুহূর্তে উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে—ব্যয় কমিয়ে বাড়তি মুনাফা করা খুবই কঠিন। এই পরিস্থিতিতে দেশের ব্যাংক থেকে যারা ঋণ নিয়েছে, তারাই পরিশোধ করতে পারছেন না। বিদেশ থেকে ঋণগ্রহণকারীদের অবস্থা আরও খারাপ। তাই বাধ্য হয়ে বাড়তি চার্জ বা ফি দিয়ে ঋণ পরিশোধের সময় পিঁছিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা।
স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের চিত্র
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের আউটস্ট্যান্ডিং বা স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১০.১৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে ডলারের এক্সচেঞ্জ রেট (বিনিময় হার) বাড়তে শুরু করার পর ব্যবসায়ীরা ডলার ঋণ পরিশোধের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। কারণ, ডলারের দর বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের বিনিময় হারের ঝুঁকি এবং লোকসান বেড়ে যাচ্ছিল। এর ফলে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর শেষে যেখানে এ ধরনের ঋণের স্থিতি ছিল ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলার, যা এক বছরের ব্যবধানে প্রায় ৪.৬৩ বিলিয়ন ডলার কমে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়ায় ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলারে। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বিদেশি ঋণের পরিমাণ বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে।
যেসব কোম্পানির ঋণ পুনর্গঠন ও ভূতাপেক্ষ অনুমোদন হচ্ছে
উল্লেখযোগ্য যেসব কোম্পানি ঋণ পুনর্গঠনের অনুমোদন পেয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলালিংক ডিজিটাল কমিউনিকেশনস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি ৩০০ মিলিয়ন ডলারের একটি ঋণের ক্ষেত্রে ঋণদাতা পরিবর্তন, পরিশোধ কাঠামো ও পরিশোধ মেয়াদে সংশোধনের অনুমোদন পেয়েছে। রবি আজিয়াটা পিএলসি— ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) থেকে নেওয়া ৯৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণ আগাম পরিশোধের জন্য অনুমোদন পেয়েছে।
উত্তরা ফুডস অ্যান্ড ফিডস (বাংলাদেশ) লিমিটেড, এইচডিএফসি সিনপাওয়ার লিমিটেড (দুটি ঋণের জন্য) এবং নতুন বিদ্যুৎ (বাংলাদেশ) লিমিটেড তাদের বড় অঙ্কের বিদ্যমান ঋণ পরিশোধের সময়সূচি, ফি ও চার্জে পরিবর্তনের অনুমোদন পেয়েছে।
এছাড়া, জেদ্দাভিত্তিক ইসলামিক করপোরেশন ফর দ্য ডেভেলপমেন্ট অব দ্য প্রাইভেট সেক্টর (আইসিডি), ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (আইডিসিওএল) ও বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড থেকে নেওয়া ৯০ মিলিয়ন ডলার অনুমোদিত ঋণের ফি ও খরচ পরিবর্তন বিষয়ক প্রস্তাবও অনুমোদন করেছে কমিটি।
একাধিক প্রতিষ্ঠান তাদের বিদেশি ঋণের জন্য ভূতাপেক্ষ অনুমোদন পেয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: ইউবিডি অ্যাকসেসরিজ লিমিটেড (০.৫৫ মিলিয়ন ডলারের ঋণ); শিমা সেইকি এমএফজি লিমিটেড (১.৮৭ মিলিয়ন ডলার) এবং বরিশাল ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (৬৯ মিলিয়ন ডলার)।
বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড তাদের ৮৩ মিলিয়ন ডলারের ঋণের 'অ্যাভেইলেবিলিটি পিরিয়ড' (ঋণ গ্রহণের সময়সীমা) বৃদ্ধির অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়াও, ঋণ-সম্পর্কিত বিভিন্ন সংশোধনী অনুমোদন পেয়েছে: আরএসজিটি বাংলাদেশ লিমিটেড, পার্ল গার্মেন্টস কোম্পানি লিমিটেড, ইউএস-ডিকে গ্রিন এনার্জি (বিডি) লিমিটেড, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড এবং বারাকা শিকলবাহা পাওয়ার লিমিটেড।
কর্মকর্তারা জানান, স্ক্রুটিনি কমিটির সার্বিক আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। তাই ব্যবসায়ীরা বৈদেশিক ঋণ অনুমোদন বা এ সংক্রান্ত যেকোন বিষয়ে বিডায় আবেদন করে। স্ক্রুটিনি কমিটির মিটিং হতে বিলম্ব হলে বিডা শর্ত সাপেক্ষে জরুরি প্রস্তাবগুলো অনুমোদন করে থাকে। ওই অনুমোদনের প্রেক্ষিতে কোম্পানিগুলো ঋণ গ্রহণ বা পরিশোধ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। পরে স্ক্রুটিনি কমিটি তা ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেয়।
গত ২১ মে স্ক্রটিনি কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হওয়ার আগে এই কমিটির বৈঠক হয়েছিল প্রায় চার মাস আগে, গত ২৮ জানুয়ারি।