মার্কিন ৩৫% শুল্কে হুমকির মুখে ১০ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা: বিপর্যস্ত হতে পারে পোশাক রপ্তানি

বাংলাদেশের রপ্তানি নির্ভর অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে এক নজিরবিহীন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পণ্যের ওপর পুনঃআরোপিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
এটি নিয়ে দুই দেশের সরকার পর্যায়ে আলোচনা চলছে। তবে, ইতোমধ্যেই অনেক মার্কিন ক্রেতা অর্ডার স্থগিত করেছেন এবং কেউ কেউ বিকল্প উৎপাদন বাজার খুঁজতে শুরু করেছেন।
সম্প্রতি, বাংলাদেশ বৈশ্বিক বাজারে একটি নির্ভরযোগ্য পোশাক সরবরাহকারী হিসেবে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে শুরু করেছে, এমন সময়ে এই শুল্ক আরোপ করা হলো। ২০২৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে ৭.৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। মহামারি থেকে শুরু করে বাজারের পরিবর্তনশীল চাহিদা— সবকিছু সামাল দিয়ে শিল্পটি ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।
কিন্তু এখন বাংলাদেশ যদি এই শুল্ক কমাতে ব্যর্থ হয়, তবে আমদের পণ্যের ওপর সর্বোচ্চ ৮২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ হতে পারে। এই শুল্ক কাঠামোর কারণে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশী রপ্তানিকারকদের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।
ইতোমধ্যেই এর প্রভাব দৃশ্যমান হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে পোশাকের অর্ডার কমে গেছে বা বাতিল হচ্ছে।
আমাদের কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের অর্ডার নেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। সব মিলিয়ে আমেরিকার বাজারে আগামী গ্রীষ্মকালের পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ ধাক্কা খাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। গ্রীষ্মকাল হলো নিট গার্মেন্ট রপ্তানির বড় মৌসুম। এই অর্ডার হ্রাসের ফলে কারখানাগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে, হুমকির মুখে পড়তে পারে কর্মসংস্থান। আমাদের অনুমান, আগামী মৌসুমে (গ্রীষ্ম ও শরৎ-শীত ২৬/২৭) মোট অর্ডারের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হারাতে পারে বাংলাদেশ।
এদিকে জর্ডান, মিশর, কেনিয়া ও ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলো মার্কিন ক্রেতাদের কাছে নতুন সম্ভাব্য উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আগ্রহের তালিকায় উঠে আসছে। কারন এসব দেশের ওপর মার্কিন শুল্ক বর্তমান সরবরাহকারী দেশগুলোর তুলনায় নগন্য। যদিও এসব দেশে অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ আছে, যার কারণে হঠাৎ করেই বড় ধরনের কোনো অর্ডার সেখানে নিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। তবে পোশাক শিল্পের ইতিহাস বলে, একবার কোনো দেশে বিনিয়োগ শুরু হলে উৎপাদন ব্যবস্থাও দ্রুতই সেসব দেশে স্থানান্তরিত হয়। যেমনটা হয়েছিল শ্রীলংকা ও চীন থেকে বাংলাদেশে ব্যবসা সরে আসার সময়।
শুল্ক হ্রাস নিয়ে উদ্ভূত অনিশ্চয়তা বাংলাদেশের জন্য একক বড় বাজারে শুধু অর্ডার হারানোর চিন্তা নয়, বরং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ক্রেতাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার ওপর ভর করে আমাদের অনেক পোশাক রপ্তানিকারক নতুনভাবে উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করছিলেন, এসব বিনিয়োগ এখন হুমকির মুখে। সরকার যদি শুল্ক কমাতে না পারে শুধু অর্ডার হ্রাস নয়, এর ফলে শ্রমিকের মজুরি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্থিতিশীলতা সবই ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কার্যকারিতা এখন অনেক উদ্যোক্তার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। দৃশ্যমান অগ্রগতির অভাবে ক্রেতাদের আস্থা কমে যাচ্ছে। কারন ইতোমধ্যে অনেক ব্র্যান্ড রপ্তানিকারকে শুল্কের কিছু অংশ বহনের জন্য চাপ দিচ্ছে, যা লাভের মার্জিন আরও সংকুচিত করছে, কারও ক্ষেত্রে তা লসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এজন্য তাদের অর্থপ্রাপ্তি বিলম্বিত করছে।
তারা যদিও এখনই নিরাশ না হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিছু পর্যায়ে আলোচনা চলছে এবং ১ আগস্ট পর্যন্ত আলোচনা চালানোর একটি সময়সীমা রয়েছে, কিন্তু এখনই কার্যকর ও কৌশলী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
আমাদের পোশাক খাতের নেতৃত্বও তাদের শিল্পের বাস্তবতা সরকারের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। শেষ মুহূর্তে এসে গত কয়েক দিন ধরে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা ভাবে কথা বলেও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ সময় এই শিল্প তাদের কাছে বলিষ্ঠ ভূমিকা প্রত্যাশা করে। এছাড়া মার্কিন তুলা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতেও ব্যর্থ হয়েছেন তারা।
আমরা মনে করি বাংলাদেশের উচিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক, পরিসংখ্যান ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা কাজে লাগিয়ে শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য জোরালো যুক্তি তুলে ধরা।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে শুধু অর্ডার নয়, বরং বিশ্বমঞ্চে এই দেশের তৈরি পোশাক খাতের দীর্ঘদিনের অর্জন ও ভাবমূর্তি চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। এজন্য প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমেরিকা সফর জরুরি। তার ব্যক্তিত্ব ও সম্পর্ক দিয়ে মার্কিন প্রশাসনের কাছ থেকে শুল্ক কমিয়ে আনতে পারেন বলে আমরা মনে করি।
পাশাপাশি, বাজার বৈচিত্র্য, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও আঞ্চলিক সংযোগ জোরদারের ওপর জোর দিতে হবে। যাতে আঞ্চলিক বাজারগুলোতে রপ্তানি বৃদ্ধি করা যায়। এজন্য সরকারের উচিত হবে শিল্পের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। বন্দর ও কাস্টমসের সেবার মান বৃদ্ধি করা। নইলে শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে; এমনকি বড় ধরনের বিপর্যয় মুখোমুখি হতে পারে বাংলাদেশ।
লেখক- সাবেক সহ সভাপতি, বিজিএমইএ