‘জন্ম সনদ চেয়েছিল, বাংলাদেশিদের সাথে যোগাযোগ আছে কি না জানতে ফোন পরীক্ষা করে’: বাংলাদেশি সন্দেহে ওড়িশায় আটক পশ্চিমবঙ্গের অভিবাসী শ্রমিক

ভারতের ওড়িশার ঝাড়সুগুড়া জেলার ব্রজরাজনগরের কাছে পুলিশের হাতে আটক পশ্চিমবঙ্গের অভিবাসী শ্রমিকদের একজন, বীরভূমের আজিমুদ্দিন শেখ (২২) জানিয়েছেন, 'আমরা ভোটার আইডি আর আধার কার্ড দেখিয়েছিলাম, কিন্তু তারা বলল এগুলো যথেষ্ট নয়। তারা জন্ম সনদ ও স্কুল সার্টিফিকেট চেয়েছিল। এমনকি আমাদের ফোন নিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের নম্বর খুঁজেছে।'
মিস্ত্রির কাজ করেন আজিমুদ্দিন। তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ ও রাজ্য প্রশাসনের হস্তক্ষেপে যারা মুক্তি পেয়েছেন, তাদের মধ্যেই তিনি একজন।
পশ্চিমবঙ্গের ৪০০-এর বেশি অভিবাসী শ্রমিককে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করেছিল ওড়িশা পুলিশ। পরে প্রায় ৫০ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কেউ কেউ অতিরিক্ত নথি দিতে পারায় মুক্তি পান, আবার অনেকের ক্ষেত্রে 'স্থানীয় জামিনদারের' জিম্মায় ছাড়া হয় বলে জানা গেছে।
বীরভূমেরই নির্মাণশ্রমিক নূর মোহাম্মদ শেখ (১৮) বলেন, 'আমরা আটজন ছিলাম। সোমবার রাত ১টার দিকে আমাদের আটক করা হয়। প্রথমেই ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। আধার বা ভোটার কার্ড গ্রহণ করেনি। পরে ফোন দিয়ে বাড়িতে ফোন করে জন্ম ও স্কুলের সার্টিফিকেট আনাতে বলা হয়। আমরা তা-ই করেছি। বৃহস্পতিবার রাত ১টার দিকে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।'
তাদের দলের আরও তিনজন—মুর্শিদাবাদের পিন্টু শেখ, গিয়াসউদ্দিন শেখ ও রাজিবুল শেখ এখনও আটক রয়েছেন। আজিমুদ্দিন দাবি করেন, 'তারা চুল কাটার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং তাদের ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাংলাদেশেও আছে। তাদের ফোনে বাংলাদেশের নম্বরও পাওয়া গেছে।'
তাদের দলের আরেক সদস্য নিজামউদ্দিন শেখ (১৮) বলেন, 'প্রতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তবে দিনে তিনবেলা খাওয়ানো হয়েছে। মুক্তির সময় ফোনগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।'
অনেককে মুক্তি পেতে হয়েছে স্থানীয় কারও জিম্মায়।
মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার নির্মাণশ্রমিক সামিউল আনসারি (৩১) বলেন, 'আমরা ছয়জন একসঙ্গে ধরা পড়ি, তিন দিন আগে। আমাদের কাগজপত্র পরীক্ষা করে, জেরা করে। পরে একজন পরিচিত ব্যক্তি জামিনদার হিসেবে এগিয়ে আসেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, পুলিশ ডাকলে আমরা হাজির হব। এরপর শুক্রবার রাত ২টার দিকে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।'
তিনি জানান, তাদের দল কাজ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
'আমাদের পরিবারের লোকজন খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। তারা পঞ্চায়েত ও স্থানীয় থানায় গিয়েছিল। আমরা ছাড়া পাওয়ার পর তাদের ফোন করে জানাই,' বলেন সামিউল।
বীরভূমের পাইকরের অধীনে থাকা গ্রামগুলোর বাসিন্দা এই যুবকদের পরিবারের সদস্যরা অবশেষে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন। আজিমুদ্দিনের বাবা ও নিজামউদ্দিনের কাকা হাসুমুদ্দিন শেখ বলেন, 'সবাই পাইকর থানা এলাকার ছেলে। আমরা খুবই স্বস্তি পেয়েছি। ওরা বহু বছর ধরে বাংলার বাইরে কাজ করছে—এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি।'
বৃহস্পতিবার কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপব্রত চক্রবর্তী ও ঋতব্রত কুমার মিত্রের ডিভিশন বেঞ্চ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব মনোজ পান্তকে ওড়িশার মুখ্যসচিব মনোজ আহুজার সঙ্গে সমন্বয় করতে নির্দেশ দিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ অভিবাসী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও তৃণমূল সাংসদ সমীরুল ইসলাম বলেন, 'ওড়িশায় আটক ও বাংলাদেশে পুশইন করা শ্রমিকদের নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে হাইকোর্টে গেছি। আমাদের পুলিশ ও প্রশাসন ওড়িশা সরকারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। এরই মধ্যে শ্রমিকদের ছেড়ে দেওয়া শুরু হয়েছে।'
তিনি অভিযোগ করেন, 'এটা শুধু ওড়িশায় নয়, অন্যান্য বিজেপিশাসিত রাজ্যেও এমন ঘটনা ঘটছে। কোথাও কোথাও তো অবৈধভাবে আটক করা হলেও আমাদের জানানোও হচ্ছে না।'
অভিবাসী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক বলেন, 'আমরা নিচুতলার পর্যায়ে কাজ করছি যাতে শ্রমিকদের মুক্তি নিশ্চিত হয়। কিন্তু সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান দেখা যাচ্ছে না। গত তিন মাস ধরে প্রায় সব রাজ্যেই এমন ঘটনা ঘটছে। দ্বিতীয়ত, মুক্তি পেলেও এরা তো পরিবার নিয়ে বাঁচে, তখন কীভাবে চলবে? পরবর্তী কাজ কোথায় পাবে?'
এই ঘটনাগুলো এমন সময় ঘটল, যখন এর আগেও ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, দিল্লি ও মধ্যপ্রদেশে বাংলা ভাষাভাষী অভিবাসী শ্রমিকদের লক্ষ্য করে একই ধরনের পদক্ষেপ দেখা গেছে।
গত জুনে মুম্বাইয়ে আটকের পর পশ্চিমবঙ্গের সাতজনকে বাংলাদেশে পুশইন করা হয়। তাদের মধ্যে চারজন মুর্শিদাবাদ, একজন পূর্ব বর্ধমান ও দুজন উত্তর ২৪ পরগনার বাসিন্দা ছিলেন। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হস্তক্ষেপে তাদের ফিরিয়ে আনা হয়।