বিদেশে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, দেশেও নেই ন্যায়বিচার: নতুন গবেষণায় উঠে এলো প্রবাসীদের দুর্দশা

বিদেশে যাওয়ার আগে চাকরির চুক্তিপত্র না পাওয়া, গন্তব্য দেশে পৌঁছে কাজ বা ওয়ার্ক পারমিট না পাওয়া এবং নিয়মিত বেতন না পাওয়ার মতো সমস্যা ভোগ করছেন অধিকাংশ বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মী। অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ) পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৫ শতাংশ কর্মী জানিয়েছেন, তাদের কোনো চাকরির চুক্তিপত্র দেওয়া হয়নি বিদেশ যাওয়ার আগে, আর ৪৭ শতাংশ গন্তব্য দেশে পৌঁছেও পাননি ওয়ার্ক পারমিট। এমনকি যাদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছেন, তাদের মাত্র ২৪ শতাংশ বাস্তবে কোনো চাকরি পান, যার বেশিরভাগই ছিল না প্রতিশ্রুত খাতে।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে বিশেষত সৌদি আরবে, হাজারো বাংলাদেশি কর্মী এই ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ করে আসছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। এই পরিস্থিতি শারীরিক নির্যাতন, মানবপাচার এবং আগেভাগে দেশে ফিরে আসার মতো চরম দুর্ভোগ তৈরি করেছে বলে উঠে এসেছে গবেষণায়।
দেশে ফিরে আসার পর এসব অভিবাসী ন্যায়বিচারের জন্য সরকারি সালিশ ব্যবস্থার দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন, কিন্তু তাদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ মিলছে না বলে ওকাপের গবেষণায় বলা হয়েছে।
বিএমইটি'র তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪৫ লাখ কর্মী বিদেশে গিয়েছেন, যার ৭০ শতাংশই গিয়েছেন সৌদি আরবে।
সৌদি আরবের প্রিন্স সুলতান বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ নুরুননবী বলেন, 'আমাদের বাংলাদেশিরা এত টাকা খরচ করে যাচ্ছে, কিন্তু গিয়ে অনেকে কাজ পাচ্ছে না। সৌদি আরবের কিছু কিছু জায়গায় সকালবেলা গেলে দেখা যায় হাজার হাজার লোক কাজের জন্য বসে আছে।'
তিনি বলেন, সমস্যার মূল জটিলতা রয়েছে নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। আমরা সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাসকে প্রস্তাব দিয়েছি—নির্দিষ্ট কোম্পানির চাকরির চাহিপত্রগুলো যাচাই করার জন্য।
এই সমস্যার বাস্তব উদাহরণ সিলেটের ২৬ বছর বয়সী আবদুল মুকিম। চার লাখ টাকার বেশি খরচ করে ৩০ জনের একটি দলের সঙ্গে সৌদি আরবে যান তিনি। প্রতিশ্রুতি ছিল, হজযাত্রীদের হোস্টেলে সাধারণ কর্মী হিসেবে চাকরি পাবেন। কিন্তু বাস্তবে কোনো চাকরিই জোটেনি এই দলের কারও।
বর্তমানে মুকিম মদিনায় আরেক প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে অস্থায়ীভাবে আশ্রয়ে আছেন, কোনোভাবে দিন পার করছেন কাজের খোঁজে।
মুকিতকে আশ্রয় দেয়া ফোরকান হোসেন টিবিএসকে বলেন, 'বর্তমানে আমার সাথে একজন আছে। কিন্তু অন্তত চারজন ছিল একমাস আগে। এরমধ্যে অনেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছে কাজের খোঁজে, কিন্তু সবাই কাজ পায়নি। বাড়ি থেকে টাকা এনে অনেকে এখানে টিকে আছে।'
ওকাপের গবেষণা 'এ ফ্রাই করাই ফ্রম জাস্টিস ফর মাইগ্রেন্টস' অনুসারে ৩৬ শতাংশ অভিবাসী তিন মাসের মধ্যে এবং ৪০ শতাংশ ছয় মাসের মধ্যে দেশে ফিরে এসেছেন—প্রধানত অবৈধ ও প্রতারণামূলক নিয়োগের কারণে। এসব কর্মী চরম দেনায় জড়িয়ে পড়েছেন এবং সম্মানহানিকর অবস্থায় জীবনযাপন করছেন।
তারা দেশে ফিরে বিএমইটির কাছে অভিযোগ দায়ের করলেও, মাত্র ৩৯ শতাংশ অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে, যেখানে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা। অথচ এসব কর্মীরা সরকারের নির্ধারিত ব্যয়ের তিন থেকে ছয় গুণ বেশি খরচ করে বিদেশে গিয়েছিলেন।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ৩৯ শতাংশ নিষ্পত্তিকৃত মামলার ক্ষেত্রেও সালিশ প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লেগেছে ১২০ কর্মদিবস। অভিযোগের পর বিএমইটি বেশিরভাগ সময়েই ভুক্তভোগীর একাধিক অনুস্মারক চিঠির পর অভিযুক্ত এজেন্সি বা দালালের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করেছে।
ওকাপের চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম বলেন, 'বিএমইটি তার নিয়মিত দায়িত্বের পাশাপাশি সালিশ ব্যবস্থাও চালায়। কিন্তু এই কাজের জন্য আলাদা জনবল বা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই, ফলে সালিশের মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।'
তিনি আরও বলেন, বিএমইটি নিয়োগ এজেন্টদের লাইসেন্স দেয় এবং অভিবাসীদের ইমিগ্রেশন ছাড়পত্র দেয়—তাদের দ্বৈত ভূমিকা সালিশ ব্যবস্থায় স্বার্থের সংঘাত তৈরি করে।
ওকাপের এই গবেষণা ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়কালে পরিচালিত হয়। এতে বিএমইটির সালিশ ব্যবস্থায় জমা পড়া মোট ১১৪টি অভিযোগ বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেগুলো দায়ের করেছিলেন প্রবাসী কর্মীরা এবং তাদের পরিবার। অভিযোগকারীদের মধ্যে ৬৮ জন ছিলেন পুরুষ এবং ৩৪ জন নারী কর্মী।
জাল মেডিকেল ও প্রশিক্ষণ সনদ, অতিরিক্ত খরচে বিদেশগামী কর্মীরা নিঃস্ব
ন্যায়সঙ্গত ও নৈতিক নিয়োগ নিশ্চিত করতে সরকারের নানা বিধিনিষেধ থাকলেও, নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়েই রয়েছে পদ্ধতিগত অনিয়ম। ওকাপের গবেষণায় অংশগ্রহণকারী অভিবাসীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন অবৈধ সাব-এজেন্টদের মাধ্যমে, যদিও বর্তমান আইনে কেবলমাত্র লাইসেন্সধারী রিক্রুটিং এজেন্সির নিয়োগ দেওয়ার অনুমতি রয়েছে।
প্রায় ২২ শতাংশ কর্মী অভিযোগ করেছেন, এজেন্টরা তাদের মেডিকেল পরীক্ষার সনদ জাল করেছেন, এবং ১৬ শতাংশ বলেছেন, তাদের প্রাক-প্রস্থান ওরিয়েন্টেশন সনদও জালিয়াতির মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়েছে—যা ইমিগ্রেশন ছাড়পত্র পাওয়ার জন্য বাধ্যতামূলক।
সব পুরুষ অভিবাসী কর্মীই অভিযোগ করেছেন, তাদের অভিবাসন ব্যয় সরকার নির্ধারিত হারের তুলনায় অনেক বেশি ছিল—সৌদি আরবগামীদের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ এবং মালয়েশিয়াগামীদের ক্ষেত্রে ছয় গুণ পর্যন্ত।
অন্যদিকে, নারী গৃহকর্মীদের জন্য সরকার 'জিরো কস্ট' অভিবাসন নীতি চালু করলেও, ৬৫ শতাংশ নারী অভিযোগ করেছেন যে, এজেন্টরা তাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছেন।
পুরুষ প্রবাসীদের অধিকার লঙ্ঘন ও ভোগান্তি
সরকার ন্যায্য ও নৈতিক নিয়োগ নিশ্চিতের জন্য নিয়ম তৈরি করলেও, নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রতিটি ধাপে গড়মিল ও অনিয়মের অবসান নেই। জরিপে অংশ নেওয়া কর্মীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ অবৈধ সাব-এজেন্টের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন, অথচ আইনে শুধুমাত্র লাইসেন্সপ্রাপ্ত এজেন্সির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া উচিত।
প্রায় ২২ শতাংশ কর্মী বলেছেন, তাদের মেডিকেল টেস্টের সনদ জালিয়াতি করা হয়েছে, এবং ১৬ শতাংশ দাবি করেছেন, তাদের প্রস্থান পূর্ববর্তী ওরিয়েন্টেশন সনদও জালিয়াতি ছিল—উভয়ই ছাড়া অভিবাসনের অনুমতি মেলেনা।
পুরুষ কর্মীদের ১০০ শতাংশ অতিরিক্ত অভিবাসন ফি দিতে হয়েছে, যা সৌদি আরবগামীদের ক্ষেত্রে সরকারি নির্ধারিত মূল্যের দ্বিগুণ এবং মালয়েশিয়াগামীদের ক্ষেত্রে ছয় গুণ। নারী গৃহকর্মীদের জন্য যেখানে সরকার 'জিরো কস্ট' নীতির ঘোষণা করেছে, সেখানে ৬৫ শতাংশ নারী অভিযোগ করেছেন যে এজেন্টরা অবৈধভাবে ৫০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করেছে।
নারী গৃহকর্মীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ
গবেষণায় অংশ নেওয়া নারী গৃহকর্মীদের মধ্যে ৯৪ শতাংশ নিয়মিত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সৌদি আরবসহ অনেক গন্তব্য দেশে গৃহকর্মীদের অধিকার জাতীয় শ্রম আইন থেকে আলাদা বিশেষ নিয়ম দ্বারা সুরক্ষিত থাকলেও, এসব নিয়ম বাস্তবায়ন না হওয়ায় তাদের ওপর ব্যাপক শোষণ ও লঙ্ঘন ঘটছে।
গবেষণায় থাকা ৩৪ জন নারী গৃহকর্মীর মধ্যে ৮২ শতাংশ অতিরিক্ত সময় কাজ করেছেন, বিশ্রামের সুযোগ ছাড়াই, এবং ৯৭ শতাংশ সপ্তাহান্ত ও ছুটির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
তাদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ বেতন না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন, ৮০ শতাংশ জানিয়েছেন খাবার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, আর ৯৭ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এছাড়া, ১৫ শতাংশ কয়েক দিন ধরে খাবার ও পানীয় ছাড়া বন্দি ছিলেন, এবং ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।