উচ্চ কর কি দেশের পোশাক খাতের সুতা আমদানির ওপর নির্ভরতা আরও বাড়াবে?

বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্পিনিং ও টেক্সটাইল মিলগুলো ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত করের কারণে গভীর সংকটের আশঙ্কা করছে। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসব পদক্ষেপ তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমাবে, দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতকে দুর্বল করবে এবং পোশাক রপ্তানিকারকরা আরও বেশি আমদানিকৃত সুতা ও কাপড়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
নতুন বাজেটে দুটি বড় পরিবর্তন নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে—স্পিনিং শিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা আমদানিতে ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) এবং স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সুতার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/ মূসক) ৬৭ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি কেজিতে ৩ টাকা থেকে ৫ টাকা করার কারণে।
সংকটে জর্জরিত খাতের জন্য 'আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত'
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল মালিক সমিতি (বিটিএমএ) এই পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করেছে। ১ জুলাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল এসব করকে "আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত" বলে উল্লেখ করেন।

চিঠিতে তিনি লিখেছেন, সরকার খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনো পরামর্শ না করেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতোমধ্যে খাতটি জ্বালানির উচ্চমূল্য, নগদ প্রণোদনা হ্রাস এবং রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে স্বল্প সুদের ঋণসুবিধা সংকুচিত হওয়ার কারণে সংকটে রয়েছে।
টেক্সটাইল খাতে ২৩ বিলিয়ন ডলারের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়লে দেশের অনেক স্পিনিং ও উইভিং মিল টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।
"নতুন করের কারণে মিলগুলো টিকে থাকার সংকটে পড়বে। আমাদের আশঙ্কা, এর ফলে দেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাতের ভিত ধীরে ধীরে ভেঙে পড়বে," আরও বলেন তিনি।
সস্তায় আমদানির কারণে দেশীয় সুতা হারাচ্ছে বাজার
নতুন করের সরাসরি প্রভাব হবে দেশীয় উৎপাদিত সুতার মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধিতে, ফলে পোশাক প্রস্তুতকারকরা আমদানিকৃত সুতার প্রতি আরও বেশি ঝুঁকবে—এমনটাই মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ফকির ফ্যাশন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ এই বাস্তবতা তুলে ধরেন। বছরে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন (৬০ কোটি) ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করা প্রতিষ্ঠানটি দুই বছর আগেও তাদের প্রয়োজনের ৫০ শতাংশ সুতা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করত, এখন তা নেমে এসেছে মাত্র ২৫ শতাংশে।
নাহিদ ব্যাখ্যা করেন, "ভারতে প্রতি কেজি সুতার দাম বাংলাদেশি টাকায় ২৮৫ টাকা। আমদানি খরচ যোগ করে আমাদের গুদাম পর্যন্ত পৌঁছাতে মোট খরচ পড়ে প্রায় ২৯৫ টাকা প্রতি কেজি। অথচ দেশীয় মিল থেকে কিনতে হলে প্রতি কেজি ৩৩০ টাকা খরচ হয়। তাহলে কোন যুক্তিতে আমরা দেশীয় মিল থেকে কিনব?"
তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, "নতুন কর চালু হলে সুতার দাম আরও বাড়বে। তখন আমরা দেশীয় সুতাকল থেকে কেনার পরিবর্তে আমদানি বাড়াতেই বাধ্য হব।"
অন্যদিকে, রপ্তানিকারকদের সুতা সরবরাহকারী শীর্ষস্থানীয় টেক্সটাইল মিল – এনজেড টেক্সটাইলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউধ জামান খান বলেছেন, "আমরা যে পরিমাণ কটন (তুলা) ইমপোর্ট করি, সেখানে নতুন করে ২ শতাংশ এআইটি (অগ্রিম আয়কর) আরোপের করার কারণে বছরে আমাদের খরচ বাড়বে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।"
তিনি বলেন, "সাধারণ মানের বা ৭ কাউন্টের ইয়ার্নের (সুতা) ক্ষেত্রে শুধু করের কারণে প্রতি কেজিতে দাম ৫ টাকার বেশি বাড়বে। অন্যদিকে যারা রপ্তানিকারকদের নয়, বরং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের কাছে সুতা বিক্রি করেন, তাদের প্রতি কেজিতে বাড়তি ২ টাকা ভ্যাট দিতে হলে তাদের জন্য খরচ ৭ টাকার বেশি হবে। এর ফলে তাদের সুতার দাম আরও বেড়ে যাবে।"
এনবিআরের আশ্বাস বনাম বাস্তবতা
এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) চেয়ারম্যান আবদূর রহমান খান দাবি করেছেন, তুলা আমদানির ওপর আরোপিত ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি) সুতার দামে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তিনি বলেন, "এআইটি বছরের শেষে আমদানিকারকের মুনাফার হিসাব অনুযায়ী সমন্বয় করা যাবে। ফলে, সুতার দাম বাড়ার কথা নয়।" টিবিএসকে তিনি আরও জানান, এ বিষয়ে শিগগিরই এনবিআর থেকে ব্যাখ্যামূলক নির্দেশনা দেওয়া হবে।
তবে শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য এ বক্তব্য কোনো স্বস্তি বয়ে আনছে না। এনজেড টেক্সটাইলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সালেউধ জামান খান বলেন, "বাংলাদেশে ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে রিফান্ড (টাকা ফেরত) পাওয়া বাস্তবে সম্ভব নয়। ফলে এ কারণে সুতার দামই বাড়াতে হবে।"
পোশাক রপ্তানিকারকরা যদিও শুল্কমুক্তভাবে কাঁচামাল আমদানি করতে পারেন, তথাপি এআইটি যদিও তাত্ত্বিকভাবে সমন্বয়যোগ্য, বাস্তবে এর রিফান্ড পাওয়া অত্যন্ত কঠিন বলে মন্তব্য করেন উদ্যোক্তারা।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে পোশাক রপ্তানিকারকরা বর্তমানে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুযোগ পাচ্ছেন। এআইটি হলো আমদানি পর্যায়ে মূল্যের উপর ট্যাক্স, যা নিয়ম অনুযায়ী পরবর্তীতে আমদানিকারকের মুনাফার হিসাব করে সমন্বয় করার কথা। কিন্তু উদ্যোক্তারা বলছেন, বাস্তবে তা খুব কমই পাওয়া যায়।
ভোক্তাপর্যায়ে প্রভাব ও চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা
এই নতুন কর এবং ভ্যাটের প্রভাব শুধু শিল্পখাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, বরং সরাসরি ভোক্তাদের জীবনযাত্রায়ও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করছেন দেশের টেক্সটাইল মিল মালিকরা। স্থানীয় বাজারে সুতা সরবরাহকারী উদ্যোক্তারা নতুন কর ও ভ্যাটের কারণে পোশাকের দাম বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন, যার চাপ স্বল্প আয়ের মানুষের ব্যবহার্য পোশাকের দামেও আসবে।
দেশের বাজারে সুতা বিক্রয়কারী লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান খোরশেদ আলম বলেন, ""সব পোশাকের দাম বাড়বে। তবে স্বল্প আয়ের মানুষের পোশাক বিশেষত থ্রি-পিছ, লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা—এসব পোশাদের দাম বাড়বে। ফলে তাদের ওপর বেশি চাপ আসবে।"
শুধু দাম বৃদ্ধি নয়, উদ্যোক্তারা আশঙ্কা করছেন, নতুন করের কারণে বৈধ ও অবৈধ পথে আমদানিকৃত সুতার মধ্যে যে মূল্য ব্যবধান তৈরি হবে, তা সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার বড় কারণ হয়ে উঠবে। বিশেষত ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাইপথে সুতা প্রবেশের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে। পাশাপাশি রপ্তানির জন্য আমদানিকৃত শুল্কমুক্ত সুতা ও কাপড় খোলা বাজারে বিক্রি হওয়ার প্রবণতাও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে বলে সতর্ক করছেন শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের নীতি বনাম ভারতের প্রণোদনা
উদ্যোক্তারা বলেন, প্রতিবেশী ভারত যখন তাদের টেক্সটাইল খাতকে নানাভাবে প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে, তখন বাংলাদেশে গত তিন বছর এখাতের ওপর ধরে চাপ বাড়ানো হচ্ছে।
সালেউধ জামান বলেন, "গত পাঁচ বছরে দেশে বিদ্যুতের দাম তিনগুণ বাড়ানো হয়েছে, ইডিএফ থেকে স্বল্প সুদের ঋণ কমেছে, যার সুদের হার এখন ১৪ শতাংশ। শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে ৭০ শতাংশ, প্রণোদনা কমে ৪ শতাংশ থেকে ১ শতাংশে নেমে এসেছে। এতে দেশীয় উৎপাদকরা চরম চাপের মধ্যে পড়েছেন।"
অন্যদিকে, ভারতে টেক্সটাইল উদ্যোক্তাদের জন্য প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারে ২ রুপি ভর্তুকি দেওয়া হয়। এছাড়া রাজ্য সরকারগুলোর পক্ষ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত মূলধনী ভর্তুকি এবং রপ্তানি মূল্যরের ওপর ৩.৮৮ শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা (রোডটেপ স্কিম) দেওয়া হচ্ছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, "ভারতের এসব সুবিধায় তাদের উদ্যোক্তাদের উৎপাদন খরচ কমছে, আমাদের খরচ বাড়ছে। ফলে আমরা প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে আর নেই। এদেশের কিছু স্বার্থান্বেষী মহল ইচ্ছাকৃতভাবে টেক্সটাইল খাত ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে।"
ঘনিয়ে আসা সংকট
বাংলাদেশের টেক্সটাইল মিলগুলোর বর্তমান সক্ষমতা রয়েছে নিটওয়্যারের জন্য ১০০ শতাংশ কাঁচামাল, এবং উভেন গার্মেন্টসের জন্য প্রায় ৬০ শতাংশ সুতা সরবরাহের। গত চার বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের নতুন বিনিয়োগও এসেছে এই খাতে।
কিন্তু এনবিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সুতার আমদানি ৩৯ শতাংশ বেড়েছে, যা বিদেশি সরবরাহের ওপর নির্ভরতা বাড়ার স্পষ্ট প্রমাণ। তাই নীতির পরিবর্তন না হলে—বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতের ভবিষ্যৎ যে আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা আরও ঘনীভূত হচ্ছে।