অতিরিক্ত উৎপাদনে মুরগির বাচ্চার দামে ধস, অস্তিত্ব সঙ্কটে ছোট হ্যাচারিগুলো

দেশজুড়ে একদিন বয়সী ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির বাচ্চার (ডিওসি) দামে রেকর্ড পরিমাণ পতন দেখা দিয়েছে। এতে করে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের ছোট ও মাঝারি হ্যাচারিগুলো। ইতোমধ্যেই প্যারেন্ট স্টক [বাচ্চা উৎপাদনকারী মুরগি] বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক হ্যাচারি মালিক।
ঈদুল আজহার আগেও ঝিনাইদহের ইউনিভার্সাল পোলট্রি হ্যাচারিজ লিমিটেডের কাছে ৭০ হাজার ব্রয়লার ও কালার প্যারেন্ট স্টক ছিল। কিন্তু মুরগির বাচ্চার (ডিওসি) দামে টানা পতনের কারণে ২০ হাজার প্যারেন্ট স্টক কেজি দরে বিক্রি করতে হয়েছে তাদের।
বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির খামারে ৫০ হাজার প্যারেন্ট স্টক থাকলেও বাজার পরিস্থিতির অবনতির কারণে ভবিষ্যৎ আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা করছে প্রতিষ্ঠানটি। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ১৮ লাখ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা।
শুধু ইউনিভার্সাল হ্যাচারিই নয়, সারা দেশের অনেক হ্যাচারি মালিকই ডিওসির দাম পড়ে যাওয়ায় টিকতে না পেরে কার্যক্রম বন্ধ বা সীমিত করে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
হ্যাচারি মালিকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে প্রতি পিস ব্রয়লার ডিওসি বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে ৮ টাকায়। যদিও এ বাচ্চা উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকা। একইভাবে লেয়ার ডিওসি ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে যেখানে এর উৎপাদনে খরচ প্রায় ৪৭ টাকা। এছাড়া কালার মুরগির বাচ্চা ২০ থেকে ২৩ টাকা ও সোনালি মুরগির বাচ্চা ৫ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
যদিও গত এপ্রিলে ডিওসির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ব্রয়লারের ক্ষেত্রে ৬০ টাকা এবং লেয়ারের বাচ্চার ক্ষেত্রে ৬৫ টাকা (ভ্যাকসিন ছাড়া) নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সে হিসেবে বর্তমানে ডিওসির মূল্য সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে প্রায় ৫ থেকে ৬ গুণ কম পাচ্ছেন।
দীর্ঘমেয়াদি দরপতন
হ্যাচারি মালিকরা বলছেন, কোরবানির ঈদের সময় মুরগির বাচ্চার চাহিদা কিছুটা কমে যাওয়া স্বাভাবিক। তবে এবারের দরপতন অস্বাভাবিক এবং দীর্ঘমেয়াদি। গত বছর বাচ্চার দাম এক পর্যায়ে ৯০-১০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। সে সময় অধিক মুনাফার আশায় অনেকে নতুন করে বিনিয়োগ করে, প্যারেন্ট স্টক বাড়ায়। ফলে এবার চাহিদার চেয়ে প্রায় ২৫ শতাংশ বেশি উৎপাদন হচ্ছে। যার কারণে এর প্রভাব পড়ছে বাজারে।
ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) তথ্যমতে, প্রতি সপ্তাহে দেশে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার চাহিদা ১ কোটি ৫০ লাখের আশেপাশে, অথচ সেখানে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২ কোটির মতো। লেয়ার বাচ্চার সাপ্তাহিক চাহিদা ১০ থেকে ১১ লাখ হলেও উৎপাদন হচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ লাখ। কালার ডিওসির চাহিদা যেখানে ২০ থেকে ২৫ লাখ, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ।
ইউনিভার্সাল পোলট্রির জেনারেল ম্যানেজার অরবিন্দ বিশ্বাস টিবিএস-কে বলেন, 'গত বছর দাম বেশি থাকায় এবার সবাই ওভার প্রোডাকশনে [অতিরিক্ত উৎপাদন] গিয়েছে। অনেকে নতুন বিনিয়োগে করে প্যারেন্ট স্টক বাড়িয়েছে। টানা দেড়-দুই মাসের লোকসানে বড় হ্যাচারি মালিকরা টিকে গেলেও ছোট হ্যাচারিগুলো আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।'
গত এক বছরে অনেক বন্ধ খামার আবারও উৎপাদনে ফিরে এসেছে। বাচ্চা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) তালিকাভুক্ত সদস্য সংখ্যা ১০০, যারা দেশের অধিকাংশ ডিওসি উৎপাদন করে থাকে।
করোনাভাইরাস মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে আগে প্রায় ৬৫ থেকে ৭০টি হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তবে গত এক বছরে এর মধ্যে ৮ থেকে ১০টি হ্যাচারি পুনরায় উৎপাদন শুরু করেছে।
বর্তমানে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের মধ্যে ৪৪টি হ্যাচারি নিয়মিতভাবে ডিওসি উৎপাদন করছে। যদিও তালিকাভুক্ত সদস্য ছাড়া আরও কিছু প্রতিষ্ঠান বাচ্চা উৎপাদন করলেও, তাদের উৎপাদনের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে খুবই কম।
বিএবি-এর প্রেসিডেন্ট ও পিপলস পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মাহবুবুর রহমান বলেছেন, পোলট্রি খাতে ২৫ বছরের অভিজ্ঞতায় তিনি কখনও এত ভয়াবহ ও দীর্ঘস্থায়ী দরপতন দেখেননি। তিনি বলেন, 'মেশিন থেকে বের হওয়ার পর বাচ্চা সঙ্গে সঙ্গেই বিক্রি করে দিতে হয়। না হলে পরে এই বাচ্চার আর কোনো ব্যবহার থাকে না। আমি ২৫ বছর ধরে এই সেক্টরে আছি—এমন দরপতন আগে কখনও দেখিনি।'
তিনি আরও বলেন, 'কোরবানির সময় সাধারণত ১৫-২০ দিনের জন্য বাচ্চার দাম কিছুটা কমে যায়, কারণ তখন মুরগির চাহিদা কম থাকে। কিন্তু এবারের মতো দীর্ঘ সময় ধরে দাম এত নিচে থাকার নজির নেই।'
চাহিদার তুলনায় অতিরিক্ত উৎপাদনই দাম কমার প্রধান কারণ উল্লেখ করে মাহবুবুর রহমান বলেন, 'গত এক বছরে প্যারেন্ট স্টকের সংখ্যা প্রায় এক-চতুর্থাংশ বেড়েছে। এমন অপরিকল্পিত সেক্টর কোনো দেশে নেই। সপ্তাহে ৪০ থেকে ৪৫ লাখ ডিওসি বেশি উৎপাদন হচ্ছে। অথচ এই সেক্টরের উৎপাদন বা বাজার পরিস্থিতি মনিটরের [পর্যবেক্ষণ] কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। একদিন বয়সী বাচ্চা বেশিক্ষণ রাখা যায় না—তাই সামান্য অতিরিক্ত উৎপাদন হলেই দ্রুত দরপতন ঘটে।'