২০২৭-২৮ অর্থবছরে ঋণভার পৌঁছাবে ২৯ লাখ কোটি টাকায়, ডেট অফিস স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারের

বাংলাদেশের সামগ্রিক ঋণ পরিস্থিতি এখনও টেকসই থাকলেও, ঋণের পরিমাণ যেমন সংখ্যায়—তেমনি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে ক্রমেই বাড়ছে। এই ক্রমবর্ধমান চাপ সামাল দিতে এবং বাহ্যিক ঝুঁকি ও রাজস্ব ঘাটতির মতো চাপ মোকাবিলায় একটি 'ইন্টিগ্রেটেড ঋণ ব্যবস্থাপনা অফিস' (ডেট অফিস) গঠনের পরিকল্পনা করছে সরকার।
অর্থ বিভাগের "মধ্য-মেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি (এমটিএমপিএস) অর্থবছর ২০২৫-২৬ থেকে অর্থবছর ২০২৭-২৮"-এ পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে যেখানে মোট ঋণ জিডিপির ৩৭.৪১ শতাংশ ছিল, ২০২৭-২৮ অর্থবছরের শেষে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৭.৭২ শতাংশে।
গত ২ জুন বাজেট নথির সঙ্গে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ঋণ স্থিতিশীলতা বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের বাহ্যিক ও মোট ঋণ ঝুঁকি এখনও তুলনামূলকভাবে কম। তবে, ভবিষ্যতে বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ রপ্তানির তুলনায় বাড়তে থাকলে—ঋণ স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। তাই টেকসইতার জন্য সক্রিয় ঋণ ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব সংস্কারের ইঙ্গিত রয়েছে এতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "ঋণ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও অর্থায়ন ঝুঁকি কমাতে— অর্থ বিভাগের অধীনে একটি ইন্টিগ্রেটেড (একীভূত) ঋণ অফিস স্থাপন করা যেতে পারে।"
বাংলাদেশের ঋণের বোঝা নীরবে কিন্তু ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে—যে গতির সঙ্গে অর্থনীতিও তাল মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে একের পর এক অর্থনৈতিক ও রাজস্বসংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ—মোট সুদ পরিশোধের চাপ, বাজেট ঘাটতি, ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা এবং জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা।
চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) শেষে সরকারের মোট ডেট স্টকের পরিমাণ দাঁড়াবে ২১.১২ লাখ কোটি টাকা। আগামী দিন অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের স্টক বাড়বে প্রায় ৫ লাখ টাকা কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণের স্টক বাড়বে প্রায় ৩ লাখ কোটি টাকা। আগামী তিন বছরে ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াবে ২৮.৯৪ লাখ কোটি টাকায়—অর্থাৎ বাড়বে ৭.৮২ লাখ কোটি টাকা, যা আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটের প্রায় সমপরিমাণ বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে অর্থ বিভাগ।
এর মধ্যে ৪০,২৬৯ কোটি টাকা থাকবে বৈদেশিক ঋণ হিসেবে, যার মধ্যে ২০২৭-২৮ অর্থবছরের জন্য ২৫,০২৮ কোটি টাকা শুধু সুদের খাতেই বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর ফলে মোট বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত দাঁড়াবে ১৪.৯৭ শতাংশে, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে ছিল ১৬ শতাংশ।
প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার এই ঋণ বৃদ্ধির মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা, আর বৈদেশিক উৎস থেকে আসবে বাকি ৩ লাখ কোটি টাকা—এমনটাই বলা হয়েছে অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে।
এঅবস্থায় রাজস্ব সংগ্রহ, রপ্তানি বহুমুখীকরণ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় দৃঢ় সংস্কার ছাড়া দেশের ওপর ঋণের চাপ ও সংশ্লিষ্ট ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে—এমন সতর্কবার্তা দিয়েছে অর্থ বিভাগের প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণের পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সুদ ব্যয়ের পরিমাণও বাড়বে। চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) যেখানে সুদ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, সেখানে ২০২৭-২৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়াবে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়—অর্থাৎ তিন বছরের মধ্যে সরকারের সুদ ব্যয় ৩১ হাজার কোটি টাকা বাড়বে।
সরকারি ব্যয় বাড়লেও – রাজস্ব আয় সে হারে না বাড়ায়, অর্থায়নের ঘাটতি পূরণে বাড়তি ঋণ নিতে হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে প্রতিবেদনটি। ফলে সামগ্রিক ঋণের পরিমাণ আরও বাড়বে। রাজস্ব সংগ্রহে স্থবিরতা এবং ঋণের সুদ পরিশোধের খরচ বৃদ্ধিকে—অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে "মধ্য-মেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতি (এমটিএমপিএস)" আগামী তিন অর্থবছরে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির হার ১০.৪ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে। পাশাপাশি, জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত স্থিতিশীলভাবে ৩৭ শতাংশের আশেপাশে রাখার জন্য সতর্ক ঋণ গ্রহণ এবং কার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনার উপর জোর দিয়েছে নীতি বিবৃতিটি।
একটি একীভূত ঋণ অফিস স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন টিবিএসকে বলেন, "বর্তমানে সরকারি ঋণের তথ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিদেশি ঋণের হিসাব-নিকাশ করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের ফরেন এইড বাজেট অ্যান্ড একাউন্টস (এফএবিএ) এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ ইন্সট্রুমেন্ট কেনাবেচার মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ বিভাগের একটি উইং এসব তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে। তবে সরকারের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতিষ্ঠান এক্ষেত্রে যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে, তার একটার সঙ্গে অন্যটা মিলানো কঠিন।"
"ডেট ম্যানেজমেন্ট করার জন্য একটি ইন্টিগ্রেটেড ডেট অফিস স্থাপন করার প্রয়োজনীয়তা আছে"- যোগ করেন তিনি।
অর্থ বিভাগের ম্যাক্রোইকোনমিকস উইং প্রণীত এমটিএমপিএস বলছে, "বাংলাদেশের ঋণ এখনও টেকসই অবস্থানে রয়েছে, তবে এটি বাহ্যিক ধাক্কা ও রাজস্ব ঘাটতির মতো চাপের মুখে রয়েছে। রপ্তানির বিপরীতে বিদেশি ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের দায় এবং মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকায়— আগামী বছরগুলোয় দেশের বৈদেশিক ঋণ স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগাম পরিকল্পিত ঋণ ব্যবস্থাপনা ও রাজস্ব সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।"
প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশকে উচ্চ সুদহার ও স্বল্পমেয়াদি পরিশোধ শর্তযুক্ত বাণিজ্যিক ঋণের ওপর আরও বেশি নির্ভর করতে হবে। এর ফলে সরকারের ঋণ পরিশোধের ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আসল ও সুদ পরিশোধের দায়বদ্ধতা
আগামী বছরগুলোতে সরকারের ঋণ পরিশোধের দায় আরও বাড়বে—এর পেছনে রয়েছে ঋণের ম্যাচিউরিটি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং কিছু ঋণে দেওয়া গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়ে যাওয়া।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শেষে বৈদেশিক ঋণের আসল পরিশোধে সরকার ২.০২ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে। এই অংক ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে বেড়ে দাঁড়াবে ২.৬১ বিলিয়ন ডলারে এবং ২০২৭-২৮ অর্থবছরের শেষে তা আরও বেড়ে ৩.৩৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক—উভয় ধরনের ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয়ও বাড়বে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যেখানে সুদ পরিশোধের মোট ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, তা ২০২৭-২৮ অর্থবছরে দাঁড়াবে ১ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়।
এই ব্যয়ের বড় অংশই হবে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদে, যা উল্লিখিত সময়ে ৯৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ১ লাখ ২৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়।
অন্যদিকে, বৈদেশিক ঋণের সুদের পরিমাণ তুলনামূলক কম হলেও, তা দ্রুতগতিতে বাড়ছে—২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা থেকে ২০২৭-২৮ অর্থবছরে এটি পৌঁছাবে ২৭ হাজার ১০০ কোটি টাকায়। ফলে জাতীয় বাজেটে বৈদেশিক সুদের অংশও বাড়বে—বর্তমানে যা ২.৪৭ শতাংশ থাকলেও, ২০২৭-২৮ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়াবে ২.৭৬ শতাংশে। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হচ্ছে, যে বৈদেশিক ঋণের আর্থিক চাপ বাজেট কাঠামোতেও ক্রমশ বাড়ছে।
কর রাজস্ব বৃদ্ধির দুর্বলতায় বাড়ছে ঋণ ঝুঁকি
অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, রাজস্ব আহরণের হার বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায়, বাংলাদেশের বাজেট এখনও তুলনামুলকভাবে প্রতিবেশী দেশ—ভারত, নেপাল কিংবা পাকিস্তানের চেয়ে ছোট।
জিডিপির তুলনায় রাজস্ব আহরণের অনুপাত অনেক বছর ধরেই ৮ শতাংশের আশেপাশে থমকে রয়েছে। এই বাস্তবতায়, সরকারি ব্যয়কে সীমিত রাখতে হচ্ছে, যা রাজস্বভিত্তিক ব্যয় সম্প্রসারণে বড় একটি কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে।
বিভিন্ন সংস্কার উদ্যোগ সত্ত্বেও, বাংলাদেশ এখনও দেশীয় রাজস্ব আহরণে অনুরূপ অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় পিছিয়ে আছে। ২০১২-১৩ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত গড় রাজস্ব বুয়েন্সি ছিল মাত্র ০.৮৩, যা ইঙ্গিত দেয় যে এই সময়জুড়ে কর রাজস্বের প্রবৃদ্ধি জিডিপির প্রবৃদ্ধির চেয়ে ধারাবাহিকভাবে কম হয়েছে।
ঋণঝুঁকি সম্পর্কে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া ঋণ যদি রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যয় না করা যায়—তাহলে এই ঋণের বোঝা সহনীয় পর্যায় থেকে দিন দিন দুদর্শায় পরিণত হয়। একইভাবে বৈদেশিক উৎস থেকে নেওয়া ঋণ ব্যবহারের মাধ্যমে যদি রপ্তানিসহ বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ না বাড়ে, তাহলে সেটিও ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
এই ঝুঁকি মোকাবিলায়, তিনি ঋণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে দেশীয় রাজস্ব আহরণ এবং রপ্তানি আয় বাড়ানোর ওপর জোর দেন। তা নাহলে, ঋণ ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে উঠতে পারে বলেও তিনি সতর্ক করেন।