চট্টগ্রাম বন্দর টার্মিনাল পরিচালনায় সাইফ পাওয়ারটেকের চুক্তির মেয়াদ ৩ মাস বাড়ানোর আবেদন

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনালের বর্তমান অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ তিন মাস বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ সময়ের মধ্যে সরকার সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'ডিপি ওয়ার্ল্ড'-কে আন্তর্জাতিক অপারেটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
নিউ মুরিং টার্মিনাল পরিচালনার জন্য সাইফ পাওয়ারটেকের বর্তমান চুক্তির মেয়াদ আগামী ৬ জুলাই শেষ হচ্ছে। এর আগে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে সর্বশেষ ছয় মাসের জন্য চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল।
নিউ মুরিং কনটেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণের প্রক্রিয়ায় বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) পরামর্শ দিচ্ছে। আইএফসি এই কার্যক্রমে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার (লেনদেন পরামর্শক) হিসেবে নিয়োজিত। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই পরিবর্তনকালে সাইফ পাওয়ারটেকের চুক্তির মেয়াদ তিন মাস বাড়ানোর প্রস্তাবও আইএফসি-র পরামর্শেই দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মুখপাত্র ও প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, 'বর্তমান অপারেটরের চুক্তির মেয়াদ ৬ জুলাই শেষ হচ্ছে। এই কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তিন মাসের জন্য নতুন করে চুক্তি বাড়ানোর জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি।'
তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিউ মুরিং টার্মিনাল (এনএমটি) পরিচালনার দায়িত্ব ডিপি ওয়ার্ল্ড-এর কাছে দেওয়ার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এ প্রক্রিয়া সরকারের এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।'
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে চালুর পর থেকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক নিউ মুরিং টার্মিনাল পরিচালনা করছে। শুরুতে মাত্র দুই বছর উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে পরিচালনার সুযোগ পায় প্রতিষ্ঠানটি; এরপর থেকে তারা সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে টার্মিনালটি পরিচালনা করছে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বন্দর অনুবিভাগের যুগ্মসচিব মুন্সী মো. মনিরুজ্জামান টিবিএসকে জানান, নিউ মুরিং টার্মিনাল পরিচালনার বর্তমান অপারেটরের চুক্তি নবায়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে শিগগিরই মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেবে।
বিদেশি অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের যে প্রক্রিয়া আগের আওয়ামী লীগ সরকার শুরু করেছিল, তা এখনো অব্যাহত রয়েছে। সরকার-টু-সরকার (জি-টু-জি) ভিত্তিক এ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে তখন একজন লেনদেন পরামর্শকও নিয়োগ করা হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সেই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিচ্ছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস বিদেশি অপারেটর নিয়োগের পরিকল্পনার বিষয়টি আবারও উল্লেখ করেন। বন্দরে তার সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, সরকার সেপ্টেম্বরের মধ্যেই ডিপি ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তিতে পৌঁছাতে চায়।
বিদেশি অপারেটর নিয়োগের বিরোধিতা
নতুন মেরিং টার্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগের পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠন ও অন্যান্য মহল থেকে তীব্র বিরোধিতা দেখা দিয়েছে। এসব সংগঠন প্রায় প্রতিদিনই বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছে। তাদের দাবি—দেশীয় অর্থায়নে নির্মিত এবং স্থানীয় অপারেটরের পরিচালনায় থাকা এই টার্মিনাল বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। তারা সরকারের কাছে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবি জানাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাবেক সদস্য ( এডমিন এন্ড প্ল্যানিং) হাদি হোসেন বাবুল বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনায় নতুন চুক্তি হওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য পূর্বের অপারেটরের মেয়াদ বৃদ্ধির ঘটনা আগেও ঘটেছে। এই টর্মিনালে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এই সময়ে নতুন কাউকে নিয়োগ দেওয়াও সম্ভব নয়। তাই বর্তমান অপারেটরের সাথে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প অন্য কিছু নেই।'
বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, 'বর্তমানে সাইফ পাওয়ারটেক ছাড়া এনসিটির কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে অন্য কোনো উপযুক্ত বিকল্প নেই। নতুন অপারেটর নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান অপারেটরের মাধ্যমে কার্যক্রম চালানোই সবচেয়ে যৌক্তিক।'
২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব ৪ হাজার কোটি টাকার অর্থায়নে নতুন মেরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ ও যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের এই টার্মিনালে পাঁচটি বার্থ রয়েছে, যেখানে সর্বোচ্চ ২০০ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। টার্মিনালে আরো রয়েছে–৭০০টি রিফার প্লাগসহ ২,৯২,২৮৭ বর্গমিটার কন্টেইনার স্টোরেজ ইয়ার্ড।
নতুন মেরিং টার্মিনালের বার্ষিক কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্ষমতা ১১ লাখ টিইইউ (টুয়েন্টি-ফুট ইকুইভ্যালেন্ট ইউনিট), যদিও বর্তমানে সেখানে বছরে ১৩ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। এই টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম বন্দর বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির প্রায় ৫৫ শতাংশ পণ্য এই টার্মিনালের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়।