স্থিতিশীল বিনিময় হার, রিজার্ভের সুবাদে বেসরকারি খাতে তিন মাসে বিদেশি ঋণ বেড়েছে ৪৫৪ মিলিয়ন ডলার

দেশে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল—এই তিন মাসে ৪৫৪ মিলিয়ন ডলার বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, ডলারভিত্তিক ঋণের তুলনায় টাকাভিত্তিক ঋণে সুদের হার বেশি, রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকা এবং বিনিময় হার অনেকটাই নির্ভরযোগ্য থাকায় এ ঋণ বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০২৫ শেষে দেশের বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯.৮ বিলিয়ন ডলার, যা গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে ঋণগ্রহণের হার বাড়তে শুরু করে, এবং এপ্রিল শেষে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০.২৫ বিলিয়ন ডলারে—যা জানুয়ারির তুলনায় ৪.৫৯ শতাংশ বেশি।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মোহাম্মদ আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কাঁচামালের আমদানি দায় পরিশোধে ইউপিএএস এলসি (ইউসেন্স পেয়েবল অ্যাট সাইট লেটার অব ক্রেডিট) খোলা এবং বাইয়ার্স ক্রেডিট নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।"
বেশকিছু কারণেই এমনটা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, "প্রথমত, আমাদের চলতি হিসাবের ভারসাম্য উন্নত হয়েছে; দ্বিতীয়ত, বিনিময় হার কিছুটা হলেও স্থিতিশীল; তৃতীয়ত, মূল্যস্ফীতি এক অংকে নেমে আসা; এবং চতুর্থত, টাকার তুলনায় ডলারে ঋণের সুদ কম থাকায়—অনেকেই বিদেশি ঋণের দিকে ঝুঁকছে।"
তিনি আরও বলেন, "সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক সূচকগুলো আগের তুলনায় উন্নতির দিকে যাচ্ছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে বিদেশে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতাও বেড়েছে, যার ফলে এখন বিদেশি ব্যাংকগুলো আমাদের গ্রাহকদের ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।"
আন্তর্জাতিক ঋণে সুদের হার প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আলী বলেন, এসব ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার সাধারণত ৮ শতাংশের মধ্যে থাকে—যার মধ্যে থাকে সোফর (সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেট) প্লাস ২.৫ থেকে ৩ শতাংশ প্রিমিয়াম। অন্যদিকে দেশে টাকায় ঋণের সুদহার প্রায় ১৩ শতাংশ। ফলে ডলারে ঋণ গ্রহণে প্রায় ৫ শতাংশ লাভ থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবছরের জানুয়ারির আগপর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সর্বনিম্ন ছিল কেবল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে—৯.২ বিলিয়ন ডলার। এরপর এই ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে ২০২১ সালের শেষে দাঁড়ায় ১৫.৪৬ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ, এক বছরের মধ্যেই বাড়ে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার।
২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলারে। তবে এরপর থেকে ঋণের পরিমাণে মাসিক হারে হ্রাস লক্ষ্য করা যায়। ঋণের স্থিতি প্রায় ২.৩ বিলিয়ন ডলার কমে যায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে। ২০২৪ সালের এপ্রিলের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮৯০ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে।
২০২৩ সালে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা হঠাৎ বিদেশি ঋণ পরিশোধ শুরু করে দেন, কারণ তারা বিনিময় হারের ঝুঁকি নিতে চাননি। এ সময় বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমে ১৬.৪২ বিলিয়ন থেকে ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আবার স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে; কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি শেষে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ১০.১৬ বিলিয়ন ডলারে।
গত ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে এক সভায় স্ক্রটিনি কমিটি অন ফরেন লোন অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট কমিটি (বৈদেশিক ঋণ ও সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট যাচাই কমিটি) মোট ২০ মিলিয়ন ডলারের বেশি নতুন ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। কমিটি ৯৮৮ মিলিয়ন ডলারের ঋণ পুনর্গঠন ও ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেয় আরও ৩১৫ মিলিয়ন ডলার ঋণে।
বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার আগে গত দুই বছর ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকায় বিদেশি ব্যাংক ও গ্রাহকদের আস্থা হ্রাস পায়। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার নেতিবাচক রেটিং যোগ হয়ে বাংলাদেশের বেসরকারিখাতের বিদেশি ঋণপ্রাপ্তি আরও কঠিন করে তোলে, যা ক্রমান্বয়ে কমতে শুরু করে। তবে এখন অর্থনীতির সূচকগুলো ধীরে ধীরে উন্নত হয়ে ইতিবাচক ধারায় আসছে, এবং বিপিএম৬ মানদণ্ডে রিজার্ভ গত এক বছর ধরে ২০ বিলিয়ন ডলারের উপরে রয়েছে, যা বিদেশি ব্যাংকের আস্থা ফিরিয়ে আনছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫ সালের এপ্রিল শেষে ডেফারড পেমেন্ট আউটস্ট্যান্ডিং দাঁড়িয়েছে ৬২২ মিলিয়ন ডলার, যা জানুয়ারির শেষে ছিল ৬৪৪ মিলিয়ন ডলার।
স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বাইয়ার্স ক্রেডিট। জানুয়ারিতে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ৫.০৮ বিলিয়ন ডলার, যা এপ্রিল শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৫৩ বিলিয়নে—তিন মাসে প্রায় ৪৪৩ মিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এ ধরনের ঋণে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে আগাম রপ্তানি আদেশের ভিত্তিতে অর্থ গ্রহণ করেন।