গাজায় হামাসবিরোধী 'অপরাধচক্র'-দের অস্ত্র সরবরাহের কথা স্বীকার করল ইসরায়েল

গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ করার কথা স্বীকার করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।
গত বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) প্রকাশিত এক ভিডিওবার্তায় তিনি এই গোপন অভিযানকে 'সঠিক পদক্ষেপ' বলে উল্লেখ করেন। নেতানিয়াহু জানান, নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পরামর্শ অনুযায়ী হামাসবিরোধী গাজাবাসীদের 'সক্রিয়' করা হয়েছে।
তবে বিরোধীরা এই উদ্যোগকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছেন।
বিষয়টি প্রথম প্রকাশ করেন ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও নেতানিয়াহুর প্রতিপক্ষ আভিগদর লিবারম্যান। তিনি ইসরায়েলের চ্যানেল ১২-এ বলেন,গাজার চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকে ইসরায়েল রাইফেল সরবরাহ করছে। ইসরায়েলের এ পদক্ষেপকে তিনি 'সম্পূর্ণ উন্মাদনা' হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
ইসরায়েলের আর্মি রেডিওকে দেওয়া আরেক সাক্ষাৎকারে লিবারম্যান বলেন, 'আমরা গাজায় আইএস-এর সমতুল্য গোষ্ঠীর কথা বলছি।' তার দাবি, নেতানিয়াহুর নির্দেশে ইসরায়েল 'গাজার অপরাধচক্রগুলোর' হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, 'এই অস্ত্রগুলো এক সময় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে না—এ বিষয়ে কি কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারে?'
লিবারম্যানের বক্তব্যের পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, 'নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের সুপারিশের ভিত্তিতে হামাস নির্মূলে বিভিন্নভাবে পদক্ষেপ নিচ্ছে ইসরায়েল।'
সিএনএনকে দেওয়া তথ্যে দুই ইসরায়েলি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চলমান এই অভিযান নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার অনুমোদন ছাড়াই শুরু করেন নেতানিয়াহু। মন্ত্রিসভাই সাধারণত নীতিগত বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণের নিয়মিত মঞ্চ হিসেবে কাজ করে। ধারণা করা হচ্ছে, নেতানিয়াহুর কট্টর ডানপন্থী জোটসঙ্গীরা এমন পদক্ষেপে আপত্তি জানিয়ে ভেটো দিতে পারে।
অন্যদিকে হামাস এক বিবৃতিতে বলেছে, এই পরিকল্পনা একটি 'গভীর ও অস্বীকারযোগ্য সত্য' উন্মোচন করেছে। গোষ্ঠীটি জানায়, 'ইসরায়েলি দখলদার বাহিনী গাজা উপত্যকায় অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর হাতে অস্ত্র তুলে দেয়ার উদ্দেশ্য সেখানে নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলার অবস্থা তৈরি করা।'
ইসরায়েল যে গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র দিচ্ছে, তাদের মধ্যে অন্যতম একটি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে রয়েছেন ইয়াসির আবু শাবাব। পূর্ব রাফার নিয়ন্ত্রিত কিছু অংশে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা সম্প্রতি এক ছবিতে একে-৪৭ রাইফেল হাতে দেখা দেন, তার পেছনে ছিল জাতিসংঘের গাড়ি।
যদিও আবু শাবাব ইসরায়েলি অস্ত্র পাওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন, হামাস তাকে 'দেশদ্রোহী' আখ্যা দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার হামাস এক বিবৃতিতে বলে, 'আমরা আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করছি—যত বড় ত্যাগই স্বীকার করতে হোক না কেন, এই অপরাধী ও তার চক্রগুলোর আস্তানার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব।'
অন্যদিকে বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা হামাসবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহ এবং পুরো পরিকল্পনার গোপনীয়তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে তীব্র সমালোচনা করেছেন। এই পদক্ষেপকে তারা দেখছেন ২০১৮ সালের শেষদিকে কাতার থেকে গাজায় নগদ অর্থ পাঠানোর অনুমতির ধারাবাহিকতা হিসেবে।
তাদের অভিযোগ, একসময় নেতানিয়াহু হামাসকে ফাতাহর বিকল্প হিসেবে শক্তিশালী করেছিলেন, আর এখন হামাসের বিকল্প হিসেবে সশস্ত্র চক্র গড়ে তুলছেন।
বিরোধী নেতা ইয়াইর লাপিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, 'নেতানিয়াহু একসময় হামাসের হাতে লাখ লাখ ডলার তুলে দিয়েছিলেন। এখন তিনি গাজার আইএস-ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীগুলোর হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন—এবং এগুলোর সবই কোনো কৌশলগত পরিকল্পনা ছাড়াই নেয়া তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত, যা আরও বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।'
এদিকে গাজার ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা কেমন হবে—সেটি নিয়ে এখনো কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রকাশ করেননি নেতানিয়াহু। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এই উপত্যকার জন্য তার পরিকল্পনা কী, তাও পরিষ্কার নয়। ইসরায়েলের যুদ্ধলক্ষ্যের অন্যতম প্রধান অংশ হলো হামাসকে পুরোপুরি নিরস্ত্র করা এবং গাজার শাসন ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া।
গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্র সরবরাহকে নেতানিয়াহুর বিকল্প শাসনব্যবস্থা গঠনের সবচেয়ে সরাসরি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
যুদ্ধ শুরুর প্রায় ২০ মাস পার হলেও ইসরায়েল এখনও গাজার বড় একটি অংশ থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসকে সম্পূর্ণভাবে উৎখাত করতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চোখে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত এই গোষ্ঠী এখনো ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে।
এ বিষয়ে বামপন্থী ডেমোক্র্যাটস পার্টির নেতা ইয়াইর গোলান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, 'মধ্যপন্থী সুন্নিদের সঙ্গে সমঝোতা ও জিম্মিদের উদ্ধার করে ইসরায়েলিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বদলে নেতানিয়াহু গাজায় আরেকটি নতুন টাইম বোমা তৈরি করছেন।'