জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গাজা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো

জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি খসড়া প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল বুধবার ওই খসড়ায় গাজায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে 'তাৎক্ষণিক, নিঃশর্ত ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি' এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ভূখণ্ড জুড়ে বাধাহীনভাবে মানবিক সহায়তা প্রবেশের আহ্বান জানানো হয়েছিল।
নিরাপত্তা পরিষদের বাকি ১৪টি দেশ এই খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ২০ লাখেরও বেশি মানুষের বসবাস গাজা উপত্যকায়। সেখানে এখন তীব্র মানবিক সংকট চলছে, দুর্ভিক্ষ ঘনিয়ে আসছে এবং গত মাসে ইসরায়েল ১১ সপ্তাহব্যাপী অবরোধ তুলে নেওয়ার পরও সেখানে খুব সামান্য পরিমাণেই ত্রাণ প্রবেশ করতে পেরেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতিসংঘে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত ডরোথি শে ভোটের আগে নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, 'মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার: আমরা এমন কোনো প্রস্তাবকে সমর্থন করব না, যা হামাসের নিন্দা করে না এবং যা হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ ও গাজা ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান জানায় না।'
তিনি বলেন, এই প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যুদ্ধবিরতির জন্য চলমান প্রচেষ্টাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
ওয়াশিংটন হচ্ছে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র এবং প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী।
নিরাপত্তা পরিষদের এই ভোটের সময় ইসরায়েল গাজায় তার সামরিক অভিযান অব্যাহত রেখেছে। মার্চে দুই মাসের যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর এই অভিযান আবার শুরু হয়েছে।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বুধবার ইসরায়েলি হামলায় ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, ইসরায়েল জানিয়েছে, লড়াইয়ে তাদের একজন সেনা সদস্য নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত বারবারা উডওয়ার্ড গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান সম্প্রসারণ এবং মানবিক সহায়তা কঠোরভাবে সীমিত করার সিদ্ধান্তকে 'অযৌক্তিক, অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং বিপরীতমুখী' বলে সমালোচনা করেছেন।
হামাস গাজায় থাকতে পারবেনা জানিয়ে ইসরায়েল এ নিঃশর্ত ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে। জাতিসংঘে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়া দেশগুলোর উদ্দেশে বলেন, 'আপনারা আত্মসমর্পণ ও তোষণের পথ বেছে নিয়েছেন। এটি শান্তির পথে নয়, বরং আরও সন্ত্রাসের দিকে নিয়ে যাবে।'
হামাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর নিন্দা জানিয়ে একে 'ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন প্রশাসনের অন্ধ পক্ষপাতিত্বের প্রমাণ' বলে উল্লেখ করেছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের খসড়া প্রস্তাবে হামাস ও অন্যান্য গোষ্ঠীর হাতে আটক সব বন্দিকে তাৎক্ষণিক ও নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানানো হয়েছিল।
ত্রাণ কার্যক্রম
গাজায় যুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩ সালে। ওই বছর ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১২০০ জনকে হত্যা করে এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। নিহত ও আটক হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সাধারণ নাগরিক দাবি ইসরায়েলের।
এর জবাবে ইসরায়েল পাল্টা সামরিক অভিযানে নামে। গাজা স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের দাবি অনুযায়ী, ইসরায়েলের এ হামলায় ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। কর্তৃপক্ষ বলছে, এই হামলার সবচেয়ে বেশি খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো হাজার হাজার মৃতদেহ চাপা পড়ে আছে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ইসরায়েল ১৯ মে থেকে জাতিসংঘের নেতৃত্বে সীমিত পরিসরে ত্রাণ সরবরাহ ফের শুরু করার অনুমতি দেয়। এর এক সপ্তাহ পর গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের একটি বিতর্কিত নতুন ত্রাণ বিতরণ সংস্থা চালু হয়, যার সমর্থনে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।
ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই হামাসের বিরুদ্ধে ত্রাণ লুটপাটের অভিযোগ করে আসছে। যদিও হামাস সবসময়ই এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। এখন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘকে জিএইচএফ-এর সঙ্গে কাজ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। এই ফাউন্ডেশন মার্কিন বেসরকারি নিরাপত্তা ও সরবরাহ কোম্পানির সাহায্যে গাজায় ত্রাণ পাঠাচ্ছে এবং তথাকথিত 'নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্রে' তা বিতরণ করছে।
ডরোথি শে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, 'গাজার ফিলিস্তিনি নাগরিকদের কেউই না খেয়ে বা পিপাসায় কষ্ট করুক—এটা কেউ চায় না।' তিনি আরও বলেন, খসড়া প্রস্তাবে পূর্ববর্তী ত্রাণ সরবরাহ পদ্ধতির ভয়াবহ ব্যর্থতা স্বীকার করা হয়নি।
অন্যদিকে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থাগুলো জিএইচএফ-এর সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, জিএইচএফ নিরপেক্ষ নয়। এটি ত্রাণকে সামরিকীকরণ করেছে এবং এটি ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক স্থানান্তরে বাধ্য করছে।
মঙ্গলবারের একটি প্রাণঘাতী ঘটনার পর, বুধবার যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) কোনো ত্রাণ বিতরণ করেনি। এর বদলে সংস্থাটি ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে তথাকথিত 'নিরাপদ বিতরণ কেন্দ্রগুলোর' আশপাশে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে।
জিএইচএফ জানায়, তারা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে অনুরোধ করেছে, সামরিক অবস্থানের বিভ্রান্তি বৃদ্ধির ঝুঁকি কমাতে এমনভাবে পদযান চলাচল পরিচালনা করা যাতে স্পষ্ট বেসামরিক নির্দেশনা প্রদান করা থাকবে এবং বেসামরিক নিরাপত্তার বিষয়ে সৈন্যদের প্রশিক্ষণ বাড়ানো হবে।
'বিলম্ব ও বাধা'
গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) ফেসবুকে জানিয়েছে, 'চলমান রক্ষণাবেক্ষণ কাজের' কারণে বৃহস্পতিবার তাদের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলো খুলতে বিলম্ব হবে। মঙ্গলবার সংস্থাটি জানায়, তারা তাদের কার্যক্রম শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৭০ লাখের বেশি খাবার বিতরণ করেছে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন গাজা ত্রাণ কার্যক্রমের সমালোচনা করছে, তবুও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে জাতিসংঘ, রেড ক্রিসেন্ট ও অন্যান্য স্বীকৃত সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের পরিকল্পনা রয়েছে। ইসরায়েল এ প্রস্তাবে সম্মতি দিলেও, হামাস কিছু পরিবর্তন চাচ্ছে, যা যুক্তরাষ্ট্র "সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য" বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ভোটের আগে, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রধান টম ফ্লেচার পুনরায় জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলোকে গাজায় সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি জোর দিয়ে বলেন, তাদের পরিকল্পনা, সরবরাহ ও অভিজ্ঞতা আছে।
টম ফ্লেচার এক বিবৃতিতে বলেন, 'সব ক্রসিং খুলে দিন। সব দিক থেকে বৃহৎ পরিসরে জীবনরক্ষাকারী ত্রাণ প্রবেশ করতে দিন। আমরা কী আনবো এবং কত আনবো—সেই সীমাবদ্ধতা তুলে দিন। আমাদের ত্রাণ বহর যেন আর বিলম্ব ও বাধার মুখে না পড়ে—তা নিশ্চিত করুন।'
জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েল ও গাজার অভ্যন্তরের আইনশৃঙ্খলার অবনতিকে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ ও বিতরণে বাধার জন্য দায়ী করে আসছে।
স্লোভেনিয়ার জাতিসংঘ দূত স্যামুয়েল জ্বোবগার নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, 'নাগরিকদের দুর্ভোগ যথেষ্ট হয়েছে। খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারও যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়।'
যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে, তাই এখন একই ধরনের মানবিক-ভিত্তিক খসড়া প্রস্তাব জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যবিশিষ্ট সাধারণ পরিষদে তোলা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ সাধারণ পরিষদে কোনো দেশের ভেটো ক্ষমতা নেই।
কূটনীতিকদের ধারণা—এই প্রস্তাব সহজেই পাস হবে।
এ প্রসঙ্গে ইসরায়েলের জাতিসংঘ দূত ড্যানি দানন হুঁশিয়ার করে বলেন, 'আর সময় নষ্ট করবেন না, কারণ কোনো প্রস্তাব, কোনো ভোট, কোনো নৈতিক ব্যর্থতা আমাদের পথ আটকাতে পারবে না।'