পরিচ্ছন্নতার রোল মডেল জাপান, তবে ট্র্যাশ ক্যানগুলো কোথায়?

জাপানে ঘুরতে গেলে আপনার সবচেয়ে বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা কী হতে পারে, জানেন?
ভাবছেন হয়তো, এমন প্রশ্নই বা আসে কোথা থেকে! জাপানের উন্নত শহুরে জীবন, ছিমছাম গ্রামীণ পরিবেশ, অ্যানিমে সংস্কৃতি এবং নান্দনিক সব মিষ্টান্ন—সব মিলিয়ে যেন স্বপ্নের মতো একটি দেশ। পর্যটকদের চোখে জাপান তো পরিপাটি, সুশৃঙ্খল ও আধুনিকতার এক নিখুঁত নিদর্শন।
সেখানে বিরক্ত হওয়ার মতো আছেই বা কী!
তবে আপনি যখন জাপান ভ্রমণে গিয়ে আবিষ্কার করেন—একদিকে তো রেস্টুরেন্টের খাবারের দাম আপনার বাজেটের বাইরে, আবার শেষমেশ দোকান থেকে একটা চিপস কিনে খাওয়ার পর দেখেন চিপসের প্যাকেটটা ফেলার জন্য আশপাশে একটা ডাস্টবিনও নেই! তখন?
হ্যাঁ, জাপান এতোটাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা দেশ, যেখানে রাস্তাঘাটে ময়লা তো নেই-ই, ময়লা ফেলার কোনও ডাস্টবিনও বলতে গেলে খুব একটা দেখা যায় না।
আবার আমাদের মতো 'কেউ দেখছে না' ভেবে প্যাকেটটা রাস্তার এক কোণায় ঠেলে দেওয়ার সুযোগও নেই কিন্তু। এমন পরিস্থিতিতে আপনি যতটা না অপরাধবোধে ভুগবেন, তার চেয়েও বেশি বিরক্ত হবেন এই ভেবে—'এতো পরিষ্কার একটা দেশে একটা ডাস্টবিন রাখা কি এতই কঠিন?'
এবং আপনি একা নন—জাপানে ঘুরতে গিয়ে যেটা নিয়ে পর্যটকদের সবচেয়ে বেশি হিমশিম খেতে হয়, সেটা হলো—ডাস্টবিন কোথায়?
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর-এর জাপানি স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ক্রিস ম্যাকমোরান, যিনি মূলত শ্রম, লিঙ্গবৈষম্য ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে গবেষণা করেন, জাপানে তার শিক্ষার্থীদের নিয়ে গবেষণা সফরে গেলে, তিনি নিজেও এই প্রশ্ন এড়াতে পারেন না।
একেবারে ঝকঝকে রাস্তাঘাট, কোথাও সামান্য ধুলো পর্যন্ত নেই, একটা চিপসের প্যাকেটও পড়ে থাকতে দেখা যায় না, আবর্জনা তো দূরের কথা। অথচ আশপাশে খুঁজেও একটা ময়লার ঝুড়ি পাওয়া যায় না!
এই বিষয়ে দিনে দিনে বিস্ময় বাড়ছে বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে।
এ বছর জাপান ছেড়ে যাওয়ার সময় পর্যটকদের মধ্যে একটি জরিপ চালায় জাপান ন্যাশনাল ট্যুরিজম অর্গানাইজেশন (জেএনটিও)। প্রশ্ন ছিল—'জাপানে ভ্রমণের সময় আপনি সবচেয়ে বড় কোন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন?'
সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে—ডাস্টবিন নেই। ২২ শতাংশ পর্যটক এটিকে তাদের প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
তুলনায়, ইংরেজি না বোঝা (১৫ শতাংশ) কিংবা জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থানে অতিরিক্ত ভিড় (১৩ শতাংশ)—এসব সমস্যা থেকেও 'ডাস্টবিন-সংকট' বড় উল্লেখযোগ্য সমস্যা বলে বিবেচিত হয়েছে।
তবে, জাপানে ময়লা ফেলার ঝুড়ির অভাবের পেছনে রয়েছে সেখানকার ভিন্নধর্মী শিষ্টাচার ও সামাজিক রীতিনীতির বিষয়।
অধ্যাপক ম্যাকমোরান বলেন, 'ডাস্টবিনের এই সমস্যাটি বিশেষ করে বাজেট-সচেতন তরুণ পর্যটকদের জন্য বেশ অস্বস্তিকর। অতিরিক্ত দামের কারণে রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়ার বদলে তারা প্রায়ই কনবিনি বা কনভিনিয়েন্স স্টোর থেকে অনিগিরি (রাইস বল) বা রাস্তায় যেকোনো স্টল থেকে ছবি তোলার উপযোগী কোনও মিষ্টান্ন কিনে খেয়ে নেন। কিন্তু খাওয়া শেষে ময়লাগুলো ফেলবেন কোথায়—এই দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তারা।'
তিনি আরও বলেন, স্থানীয় জাপানিরাও কনবিনি বা ভেন্ডিং মেশিন থেকে খাবার কিনলেও সাধারণত সেটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে খান না। কারণ জাপানে হাঁটতে হাঁটতে কিছু খাওয়াকে রীতিমতো অসভ্যতা হিসেবে দেখা হয়। কিছু শহরে এ অভ্যাস নিষিদ্ধও করা হয়েছে।
ফলে স্থানীয়রা সাধারণত এসব খাবার বাসা বা অফিসে নিয়ে গিয়ে খান এবং পরে সেখানে ময়লা ফেলে দেন। আবার কেউ কেউ বাইরে খাওয়ার সময় নিজের ব্যাগেই ছোট একটা পলিথিন বা থলে রাখেন, যাতে ময়লাগুলো সারাদিন জমিয়ে পরে বাসায় গিয়ে ফেলতে পারেন।
জাপানে পর্যটনের প্রসার যেমন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করেছে, তেমনি বাড়িয়েছে জনসমক্ষে ময়লা ব্যবস্থাপনার চাপ।
ওসাকার পাশের ইউনেস্কো ঘোষিত শহর নারা-তে সেই চাপের চিত্র আরও স্পষ্ট। ইতিহাস আর মন্দিরের জন্য নয়, নারা এখন বিখ্যাত সেখানকার হরিণদের জন্য—যারা পর্যটকদের কাছ থেকে বিস্কুট খেয়ে মাথা নেড়ে 'ধন্যবাদ' জানায়।

কিন্তু এ পর্যটনের ভিড়েই হুমকির মুখে পড়েছে হরিণগুলো। ২০১৯ সালে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া ময়লা খেয়ে নয়টি হরিণের মৃত্যু হয়।
হরিণদের ময়লা খেয়ে ফেলা ঠেকাতে ১৯৮৫ সালেই নারার পার্কগুলো থেকে ডাস্টবিন তুলে ফেলা হয়। শহরজুড়ে সাইনবোর্ডে অনুরোধ জানানো হয়—এখানে ময়লা ফেলা যাবে না, কারণ হরিণের স্বাভাবিক খাদ্যতালিকার বাইরে কিছু খেলে সেটি তাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
কিন্তু পর্যটকসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর বোঝা যায়—শুধু সাইনবোর্ড দিয়ে কাজ হচ্ছে না। ফলে শহর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত পাল্টে ব্যস্ত এলাকাগুলোর আশপাশে কয়েকটি ডাস্টবিন বসায়।
যদিও সেসব সৌরশক্তি চালিত ময়লার ঝুড়িগুলোতে ইংরেজিতে লেখা—'সেইভ দ্যা ডিয়ার' (Save the deer)।

টোকিওর জনপ্রিয় শিবুয়া এলাকাও একই সমস্যায় পড়েছে। পর্যটকদের জন্য বিখ্যাত হলেও, বিশেষ করে হ্যালোইন উৎসবের সময় এ এলাকায় নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। অতিরিক্ত শব্দদূষণ ও ময়লার পরিমাণ কমাতে সেখানকার রাস্তায় মদপান নিষিদ্ধ করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

টিকটকে জাপানি ভদ্রতা ও শিষ্টাচার নিয়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ভিডিও—বিশেষ করে পর্যটকদের জন্য কীভাবে আচরণ করা উচিত, তা নিয়েই। কেউ কেউ জাপানকে কানাডা বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, জনসাধারণের পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে জাপান অনেক এগিয়ে। কেউ কেউ আবার জরুরিভাবে ময়লা ফেলতে চাইলে কোথায় ডাস্টবিন খুঁজে পাওয়া যায় (বেশিরভাগ ভেন্ডিং মেশিনের পাশে একটি ছোট ঝুড়ি থাকে) এসব বিষয়েও পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
একদিকে কিছু পর্যটকের কাছে ময়লা ফেলার ঝুড়ির অনুপস্থিতি জাপানি সংস্কৃতির এক ধরণের 'মনোমুগ্ধকর বৈশিষ্ট্য'। অন্যদিকে অনেকের কাছে এটি বেশ বিরক্তিকর।
হংকংয়ের বাসিন্দা রুবিন ভেরেবেস তেমনই এক পর্যটক। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার জাপান ভ্রমণে গিয়ে এই সমস্যার মুখোমুখি হন।
তিনি বলেন, 'পুরো দিন টোকিও শহরে হাঁটাহাঁটি করে ২০ হাজার ধাপ পার করলাম, অথচ সামান্য একটা প্লাস্টিক র্যাপার ফেলার জন্য একটা ডাস্টবিনও খুঁজে পেলাম না—এটা সত্যিই হতাশাজনক।'
তার অভিযোগ, 'কিছু সেভেন-ইলেভেন, ফ্যামিলি মার্ট বা লসনের মতো কনভিনিয়েন্স স্টোর দোকানেও কোনো ঝুড়ি ছিল না। ফলে হাতে করে সারাদিন এসব গন্ধযুক্ত মোড়ক বা বোতল নিয়ে সারাদিন ঘুরতে হয়েছে—যতক্ষণ না পর্যন্ত হোটেলে ফিরেছি। শহরগুলো বেশ পরিষ্কার, এটি অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু সারাক্ষণ ময়লা হাতে রাখা সত্যিই বিরক্তিকর।'
'ওয়াক জাপান' নামের একটি ভ্রমণ সংস্থা-এর সিইও পল ক্রিস্টি জানান, ময়লার ঝুড়ির অভাব নিয়ে ক্লায়েন্টদের অভিযোগ আসলে তিনি স্থানীয় সম্প্রদায়ের মূল্যবোধ ও তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ওপরই গুরুত্ব দেন।
ক্রিস্টি বলেন, 'জাপানি সমাজ পরিচ্ছন্নতাকে গুরুত্ব দেয় এবং সবাই মিলে তা বজায় রাখে। যার কারনেই, দেশটি বিশ্বের শৃঙ্খলাবদ্ধ ও পরিপাটি দেশের মধ্যে শীর্ষে থাকে।'
তিনি আরও বলেন, 'শেষ পর্যন্ত জাপানি সম্প্রদায় জনসাধারণের ময়লা ঝুড়ির ঝামেলা ও খরচ এড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর ক্রেতারা কেনাকাটার সময় নিজেদের ময়লা নিজেরাই নিষ্পত্তির পরিকল্পনা মেনে নিয়েছে।'
জাপানে ময়লার ঝুড়িগুলোর আকার ক্রমশই ছোট হওয়ার কারণ জাপানে পুনর্ব্যবহার বৃদ্ধির প্রচেষ্টা জোরদার হয়েছে। অধ্যাপক ম্যাকমোরান বলেন, কিছু পৌরসভায় পুনর্ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যের প্রায় ২০টি আলাদা ভাগ রয়েছে, যা সঠিকভাবে বাছাই করা অনেক স্থানীয়র জন্যও কঠিন।
তিনি বলেন, 'পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পাবলিক পরিবহন ব্যবস্থা একটি দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ, এতে যাত্রীরা স্টেশন, ট্রেন, বাস এবং একে অপরকে সম্মান প্রদর্শন করেন।'
তবে পরিচ্ছন্নতা ও শিষ্টাচারের বাইরে ময়লার ঝুড়ি না থাকার আরও একটি গম্ভীর কারণ রয়েছে।
১৯৯৫ সালের ২০ মার্চ, জাপানের অম শিনরিকিও নামের দুর্বৃত্তরা টোকিওর মেট্রো ট্রেনে সারিন গ্যাস ছোড়ে, যার ফলে ১৪ জন নিহত হন এবং কমপক্ষে ৫ হাজার ৫০০ জন আহত হন।
সেই সদস্যরা প্লাস্টিকের ছোট প্যাকেটে সারিন গ্যাস নিয়ে মেট্রো ট্রেনে ঢুকে মেঝেতে ফেলে দেয় এবং বের হয়ে যাওয়ার সময় ছাতা দিয়ে প্যাকেট ফাটিয়ে গ্যাস ছড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে ট্রেন পরিষ্কার করতে গিয়ে এবং যাত্রীদের সাহায্য করতে গিয়ে অনেক মেট্রো কর্মীও মারা যান।

এই ঘটনা জাপানকে রীতিমতো আতঙ্কিত করে তোলে এবং পরবর্তীতে দেশের নিরাপত্তা নীতিতে বড় পরিবর্তন আনে।
ফলে, মেট্রো ও রেল স্টেশন থেকে ময়লার ঝুড়ি সরিয়ে ফেলা হয়। এখনও কিছু ঝুড়ি থাকলেও সেগুলো পরিষ্কার প্লাস্টিকের ব্যাগে থাকে, যাতে পুলিশ সহজে দেখতে পারে ভিতরে কী আছে।
এবং এমন ঘটনা শুধুমাত্র জাপানে সীমাবদ্ধ নয়।
৭০-এর দশকে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির (আইআরএ) বোমা হামলার পর লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনগুলো এবং প্রধান সড়কগুলো থেকে অনেক ডাস্টবিন সরিয়ে ফেলা হয়েছিল।
জাপানি কর্তৃপক্ষও বিদেশের সন্ত্রাসবাদী ঘটনাগুলো খুব কাছ থেকে নজরদারি করে। ২০০৪ সালে মাদ্রিদে ট্রেন বোমা হামলার পর দুইটি জাপানি রেললাইনও সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা দেখিয়ে ময়লার ঝুড়ি রাখা বন্ধ করে দেয়।
তবে যদি আপনি পর্যটক হিসেবে সারাদিন ময়লা সঙ্গে নিয়ে বেড়ানো নিয়ে চিন্তিত থাকেন, তবে জাপানের নতুন সমাধান—'ফুরোশিকি' আপনার কাজে আসতে পারে। এটি একটি বর্গাকৃতির কাপড়ের টুকরা, যা প্রায় সব জাপানি দোকানে সহজেই পাওয়া যায়। ফুরোশিকি দিয়ে আপনি একদিকে সহজে ময়লা বহন করতে পারেন, আবার ভ্রমনের পর এটি আপনার বাড়ির সাজসজ্জায়ও দিতে পারে নতুন প্রাণ।