ইতিহাসের পাতা থেকে কোথায় হারালেন জাপানের সামুরাইরা; কেউ হলেন কবি, কেউ মাফিয়া

জাপান বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ক্ষিপ্রগতির তলোয়ার হাতে একদল দুর্ধর্ষ যোদ্ধার ছবি। সিনেমার পর্দা থেকে শুরু করে কমিকসের পাতা পর্যন্ত—সর্বত্রই তাদের বীরত্বগাঁথা। তারাই সামুরাই, জাপানের কিংবদন্তিতুল্য যোদ্ধা শ্রেণি। নিজেদের ব্যতিক্রমী যুদ্ধ-দক্ষতা দিয়ে তারা জাপানের ইতিহাসে এমনভাবে নিজেদের নাম খোদাই করেছেন যে, আজ সামুরাই জাপানি সংস্কৃতিরই এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, যে সময়টাকে সামুরাইদের স্বর্ণযুগ বলে মনে করা হয়, সেই তোকুগাওয়া শোগান আমলেই (১৬০৩-১৮৬৮) আসলে তাদের পতনের সূচনা হয়েছিল। দীর্ঘ প্রায় আড়াইশো বছরের শান্তি আর সমৃদ্ধির সেই যুগই তলোয়ারের ঝনঝনানি থামিয়ে দিয়ে সামুরাইদের ঠেলে দিয়েছিল এক নতুন বাস্তবতার দিকে। কোথায় হারিয়ে গেলেন সেই কিংবদন্তি যোদ্ধারা? চলুন, সেই ইতিহাসটাই খুঁজে দেখা যাক।
শান্তির সময়ে অকেজো যোদ্ধারা
৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে জাপানের হেইয়ান যুগে শুরু হয়েছিল সামুরাইদের উত্থান। শুরুতে তারা ছিল শুধু দক্ষ যোদ্ধা, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অভিজাত পরিবারগুলোর সান্নিধ্য তাদের এনে দেয় সম্মান আর ক্ষমতা—দুটোই। ধীরে ধীরে 'বুশি' নামে পরিচিত এই সামুরাইরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুদ্ধ আর সংঘাতের মধ্য দিয়ে জাপানের ইতিহাসের গতিপথ বদলে দেয়।
কিন্তু ১৬১৫ সালে ওসাকা দুর্গ দখলের মধ্য দিয়ে দৃশ্যপট আমূল পাল্টে যায়। তোকুগাওয়া শোগানরা দেশে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির যুগ শুরু করেন। কৃষক বিদ্রোহ ছাড়া বড় কোনো যুদ্ধ আর জাপানের মাটিতে হয়নি। শেষ বড় সংঘাত ছিল শিমাবারা বিদ্রোহ —যা শুরু হয়েছিল অতিরিক্ত কর আর খ্রিস্টানদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে। সেই বিদ্রোহের নেতৃত্বে ছিলেন আমাকুসা শিরো, এক রহস্যময় ব্যক্তিত্ব—একদিকে খ্রিস্টান, অন্যদিকে সামুরাই। তার মধ্যে ছিল বুশিদের যোদ্ধা সত্তা আর জেসুইট মিশনারিদের শেখানো মুক্তির আদর্শ, দুইয়ের অদ্ভুত মিশ্রণ। তবে সেই বিদ্রোহও টিকল না; সরকারি বাহিনী ডাচ বণিকদের কামানের সাহায্যে সেটি নির্মমভাবে দমন করে।
এই ঘটনার পর শোগান ইয়ামিৎসু বিদেশি প্রভাব রুখতে 'সাকোকু' নামে এক কঠোর বিচ্ছিন্নতাবাদী নীতি চালু করেন। এর ফলে দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে জাপানে আর কোনো বড় যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু এই শান্তির এক অপ্রত্যাশিত ফলও ছিল—সামুরাইরা রাতারাতি হয়ে গেল প্রায় অপ্রয়োজনীয়। যোদ্ধা বংশের উত্তরসূরিদের আর যুদ্ধক্ষেত্রে ডাকার কেউ রইল না। টিকে থাকতে হলে তাদের খুঁজে নিতে হলো যুদ্ধের বাইরের নতুন জীবনের পথ।
তলোয়ার যখন শুধু প্রদর্শনের বস্তু
শান্তির যুগে হলেও কিছু সামুরাই রইলেন, যারা দ্বন্দ্বযুদ্ধ বা প্রদর্শনীর মাধ্যমে তলোয়ারের দক্ষতা দেখিয়ে যেতেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন মিয়াওমোতো মুসাশি । ইতিহাসবিদদের মতে, তিনি হয়তো ১৬০০ সালের সেকিগাহারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, যা তোকুগাওয়া আমলের আগে শেষ বড় যুদ্ধগুলোর একটি।

যুদ্ধের পর মুসাশি কোনো প্রভুর অধীনে না থেকে নিজের উদ্ভাবিত দুই-তরবারি কৌশল নিয়ে সাধনা শুরু করেন—ছোট তলোয়ার এর নাম ওয়াকিজাশি এবং লম্বা তলোয়ার কাতানা। তিনি প্রায় ৭০টি দ্বন্দ্বযুদ্ধে অংশ নেন এবং সবগুলোতেই জয়ী হন। মৃত্যুর আগে তিনি মার্শাল আর্ট নিয়ে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন, যার নাম 'গোরিন নো শো' (বুক অফ ফাইভ রিংস)।
সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ নিষিদ্ধ করা হয় এবং আত্মরক্ষা ছাড়া তলোয়ার ব্যবহারেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর ফলে সামুরাইদের কৌশলেও এসেছে নতুন রূপ। তারা প্রতিপক্ষকে উসকানি দিতেন, যাতে শত্রু আগে আক্রমণ করে এবং তারপর আত্মরক্ষার নামে তলোয়ার চালানো যায়। অনেক সামুরাই 'ইয়াইজুৎসু' নামে এক বিশেষ কৌশল আয়ত্ত করেন, যেখানে বিদ্যুৎগতিতে কাতানা বের করে প্রতিপক্ষকে আঘাত করার আগেই তাকে অসহায় করা হতো।
'রোনিন' বা লক্ষ্যহীন সামুরাই
সামুরাইদের মর্যাদায় এই নাটকীয় পরিবর্তনের ফলে জন্ম নেয় 'রোনিন'—প্রভুহীন সামুরাই। জাপানি ভাষায় 'রোনিন' শব্দের অর্থ 'ঢেউয়ের মানুষ', যা তাদের লক্ষ্যহীন, শেকড়হীন জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে, যেন তারা পানির ওপর ভাসমান পাতা। ধীরে ধীরে রোনিনদের ঘিরে এক রোমান্টিক ধারণা তৈরি হয়। তাদের এমন এক বেপরোয়া যোদ্ধা হিসেবে দেখা হতে থাকে, যারা যেকোনো অসাধ্য সাধন করতে পারে। মিয়াওমোতো মুসাশি ছিলেন এই ধারণার সেরা উদাহরণ।
কিন্তু বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। বেশিরভাগ রোনিনই ছিলেন তলোয়ারধারী ভবঘুরে। জীবন ধারণের জন্য তাদের দেহরক্ষী, ভাড়াটে গুন্ডা বা সাধারণ শ্রমিকের মতো কাজও করতে হতো।
তলোয়ার থেকে মাফিয়া: ইয়াকুজার উত্থান
যখন সামুরাইরা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে লড়ছিল, তখন এডো (বর্তমান টোকিও) শহর যেন নতুন করে ফেঁপে উঠছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছিল, শহর হয়ে উঠছিল ধনী ও জনবহুল। সামন্ত প্রভুদের বছরে ছয় মাস এডোতে থাকা বাধ্যতামূলক থাকায় সামুরাই ও তাদের চাকর-বাকরের উপস্থিতি শহরের জৌলুস আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
এই সুযোগে বহু রোনিন এডোতে ঢুকে পড়েছিল। কেউ কেউ সংগঠিত হয়ে দল তৈরি করে চাঁদাবাজি, পতিতালয় ব্যবসা এবং অন্যান্য অপরাধমূলক কাজে হাত দেন। ধীরে ধীরে এই দলগুলো বুশিদো কোডের বিকৃত সংস্করণকে ভিত্তি করে নিজস্ব আইন ও নিয়ম তৈরি করে। এভাবেই জন্ম নেয় জাপানের কুখ্যাত মাফিয়া ইয়াকুজা।

ইয়াকুজার পরিবারগুলো দেখতে সামুরাই গোষ্ঠীর মতোই ছিল। তাদের অস্ত্র, ট্যাটু এবং পোশাক সাধারণ মানুষের মনে ভয় তৈরি করত—ঠিক যেমন সামুরাইরা দাইশো (কাতানা ও ওয়াকিজাশির জোড়া) এবং পারিবারিক প্রতীক বা কামোন দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিত। এমনকি ইয়াকুজা সদস্যরা কোনো ভুল করলে সম্মানজনক শাস্তি হিসেবে নিজেদের আঙুল কেটে নিত, যা ছিল সামুরাইদের হারিকিরি বা আত্মহত্যার অনুকরণ।
ঋণের জালে জর্জরিত সামুরাই
যেসব সামুরাই কোনো দাইময়ো বা সামন্ত প্রভুর অধীনে চাকরি ধরে রাখতে পেরেছিলেন, তাদের জীবনও তেমন আরামদায়ক ছিল না। প্রভুর সঙ্গে এডোতে থাকাকালীন তারা সামান্য ভাতার বিনিময়ে প্রশাসনিক কাজ বা পাহারা দেওয়ার মতো ছোটখাটো দায়িত্ব পালন করতেন। আইনে ব্যবসা বা বিনিয়োগে নিষেধাজ্ঞা থাকায় প্রায়ই অর্থের ঘাটতিতে পড়তেন।
অনেকেই শহরের সরাইখানা-তে মদ্যপান করে এবং যোশিওয়ারা নামক বিনোদনপাড়ায় সময় কাটাতেন। এর ফলে তারা শহরের উঠতি বণিক শ্রেণির কাছে ঋণের জালে জড়িয়ে পড়তেন। কেউ কেউ নিজের তলোয়ার পর্যন্ত বিক্রি করতেন, যা দিয়ে মিজুয়াগে নামক জাপানি নারী বিনোদনশিল্পীদের কুমারীত্ব বিসর্জনের অনুষ্ঠান বা অন্যান্য বিলাসিতার খরচ মেটাতেন।
তবে সবাই একরকম ছিলেন না
তবে সব সামুরাই যে এমন অবক্ষয়ের পথে হেঁটেছিলেন, তা নয়। কেউ কেউ শিল্প-সাহিত্যের জগতে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। যেমন মাৎসুও বাশো, যিনি জাপানের সর্বশ্রেষ্ঠ হাইকু কবিদের একজন। তিনি এক প্রাচীন সামুরাই পরিবারের সন্তান ছিলেন। তরুণ বয়সে এক সামন্ত প্রভুর অধীনে কাজ শুরু করলেও তার সাহিত্য প্রতিভা তাকে সামরিক জগৎ থেকে দূরে নিয়ে যায়।
চিত্রশিল্পের জগতে ওয়াতানাবে কাজান ঐতিহ্যবাহী জাপানি 'উকিয়ো-ই' চিত্রকলার সাথে ইউরোপীয় বাস্তবতাবাদকে মিলিয়ে এক নতুন ধারার জন্ম দেন। একইভাবে কাওয়ানাবে কিয়োসাই নামক আরেক শিল্পী, যাকে আধুনিক মাঙ্গা বা জাপানি কমিকসের অন্যতম জনক বলা হয়, তিনিও ছিলেন এক সামুরাই।
যোদ্ধা থেকে আমলা ও রোনিনের প্রতিশোধ
কিছু সামুরাই আবার যোদ্ধা হিসেবে নয়, বরং মন্ত্রী বা আমলা হিসেবে তোকুগাওয়া শোগানদের দরবারে ক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। এমনই একজন ছিলেন কেইরা যোশিনাকা , যিনি অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তার সাথে এক বিবাদে জড়িয়ে দাইময়ো আসানো নাগানোরি তাকে আক্রমণ করেন এবং শাস্তি হিসেবে তাকে 'সেপ্পুকু' বা হারাকিরি করে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

এই ঘটনাই জাপানের বিখ্যাত '৪৭ রোনিনের প্রতিশোধ' কাহিনীর জন্ম দেয়। প্রভুর মৃত্যুর পর তার অনুগত সামুরাইরা রোনিন হয়ে যায় এবং এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করে কেইরাকে হত্যা করে প্রভুর হত্যার প্রতিশোধ নেয়। পরে অবশ্য তাদের সকলকেই হারাকিরি করে মৃত্যুবরণ করতে হয়।
শেষ কথা
অদ্ভুত হলেও সত্যি, জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামুরাই শোগান তোকুগাওয়া ইয়েয়াসুর বিজয়ই হয়ে ওঠে তাদের নিজের শ্রেণীর পতনের কারণ। 'বুশিদো' কোড তার প্রাথমিক অর্থ হারিয়ে ফেলে, আর সামুরাইদের নিয়ে গড়ে ওঠে এক কাল্পনিক বীরের ইমেজ।
উনিশ শতকে যখন জাপান পশ্চিমা শক্তির হুমকির মুখে পড়ে, তখন এই যোদ্ধাদের পুরনো আদর্শকে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিলিয়ে সম্রাটের সেবায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করা হয়। আজ সামুরাইরা শারীরিকভাবে আর নেই, কিন্তু তাদের শৃঙ্খলা, শৈল্পিক সংবেদনশীলতা এবং বীরত্বের আদর্শ আজও জাপানের সামরিক ঐতিহ্য এবং সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ছড়িয়ে আছে।
অনুবাদ : নাফিসা ইসলাম মেঘা