গাজায় ইসরায়েল-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা ইয়াসির আবু শাবাব কে?

দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় এক সশস্ত্র এক গোষ্ঠীর নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন ইয়াসির আবু শাবাব—যার দল 'পপুলার ফোর্সেস' সম্পর্কে ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলছেন, তারা হামাসকে দুর্বল করতে এই গোষ্ঠীকে অস্ত্র দিয়েছেন। যদিও আবু শাবাব নিজে ইসরায়েলের কাছ থেকে অস্ত্র পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
৩০ বছরের এই বেদুইন যুবক এখন পূর্ব রাফাহ এলাকায় সেই অস্ত্রের জোরে প্রভাব বিস্তার করছেন। এটি ইসরায়েল ও গাজা ভূখণ্ডের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিংয়ের নিকটবর্তী এলাকা।
তাকে ঘিরে বিতর্ক বহুদিনের। গাজায় মানবিক সাহায্য পৌঁছাতে যাওয়া ট্রাক লুট করার অভিযোগ রয়েছে আবু শাবাব ও তার অনুগামীদের বিরুদ্ধে।
কেন ইসরায়েল আবু শাবাবের সঙ্গে কাজ করছে?
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি জানিয়েছেন, গাজার ভেতরে হামাস-বিরোধী গোত্রগুলোর সঙ্গে কাজ করছে তার সরকার। "এর মধ্যে খারাপ কী?"—বলেছেন তিনি। "যখন এই পন্থা আমাদের সেনাদের জীবন বাঁচায়।"
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই পদক্ষেপ ইঙ্গিত দেয় নেতানিয়াহু এখনো গাজার ভবিষ্যৎ শাসন ব্যবস্থা নিয়ে দ্বিধায় আছেন। ইসরায়েলি জেনারেল শ্লোমো ব্রোম বলেন, "হামাসের বিকল্প হিসেবে আপনি হয় ইসরায়েলি সামরিক প্রশাসন অথবা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে ভাবতে পারেন। কিন্তু নেতানিয়াহু এ দুই পথেই যেতে চান না।"
কারণ, গাজার পূর্ণাঙ্গ দখল আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ; আর ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ মানে 'ফিলিস্তিন রাষ্ট্র' নিয়ে আলোচনা—যা বর্তমান ডানপন্থী ইসরায়েলি নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি নয়।
খাদ্য সহায়তা লুটের অভিযোগ
স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ী, চালক ও আন্তর্জাতিক মানবিক কর্মীরা আবু শাবাবকে বড় ধরনের ত্রাণ-লুটকারী চক্রের প্রধান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা তাকে বলেছেন "পূর্ব রাফাহর স্বঘোষিত ক্ষমতার খেলোয়াড়"।
২০২৪ সালের নভেম্বরে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবু শাবাব স্বীকার করেন যে তার দল অন্তত ছয়টি ত্রাণবাহী ট্রাক থামিয়েছে। তবে তিনি বলেন, "আমরা খাবারের জন্য ট্রাক নিচ্ছি, বিক্রির জন্য না। যার ক্ষুধা আছে, সেও তো সাহায্য নিচ্ছে।" তিনি দাবি করেন, সবচেয়ে বেশি ত্রাণ লুট করেছে হামাস, যদিও হামাস বরাবরাই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করছে। এর আগে ইসরায়েলও হামাসের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনে। আন্তর্জাতিক সংস্থা বা গাজার সাধারণ ফিলিস্তিনিদের থেকে হামাসের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ শোনা যায়নি।
গাজায় ত্রাণ পরিবহন কাজে নিযুক্ত ট্রাকের চালকরা বলছেন, আবু শাবাবের অনুসারী বলে পরিচয় দেওয়া লোকজন ট্রাক থামিয়ে জোর করে মালের বস্তা নামিয়ে নিয়েছে।
গাজায় 'পপুলার ফোর্সেস' কী করছে?
এই দলটি মে মাস থেকে নিজেদের অস্ত্রসজ্জিত ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা শুরু করেছে। এক সাম্প্রতিক ভিডিওতে আবু শাবাব পূর্ব রাফাহর বাসিন্দাদের বাড়ি ফেরার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তাদের জন্য "খাদ্য, ওষুধ ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকবে।"
তিনি দাবি করেন, তারা "ফিলিস্তিনি বৈধতার" আওতায় কাজ করছেন—যা সাধারণত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে বলা হয়। তবে পশ্চিম তীরভিত্তিক এই কর্তৃপক্ষ এখনো শাবাবের সঙ্গে কোনোপ্রকার সম্পর্কের বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এদিকে এই সশস্ত্র গোষ্ঠীটি দাবি করেছে, তারা মে মাসে ৯২টি ত্রাণের ট্রাক গাজায় নিরাপদে প্রবেশে সাহায্য করেছে এবং সেগুলো রক্ষা করেছে—তবে কোন সংস্থা এসব ট্রাক পাঠিয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। তারা বলছে, জাতিসংঘের ট্রাকগুলোকেও তারা সুরক্ষা দিয়েছে।
হামাসের প্রতিক্রিয়া
গত নভেম্বরে হামাসের নিরাপত্তা বাহিনী আবু শাবাবের এলাকায় অভিযান চালায়—যেখানে তার দাবি অনুযায়ী, তার ভাইসহ ২০ জন নিহত হয়। তিনি বলেন, হামাস বাহিনী "যাকে পেয়েছে, তাকেই মেরেছে।"
হামাসের সরকারি মিডিয়া তখন দাবি করেছিল, তারা সাহায্য লুট করা 'ডাকাত দলের' ২০ সদস্যকে হত্যা করেছে।
এই ঘটনার মাধ্যমে স্পষ্ট, গাজায় এখন কেবল ইসরায়েল ও হামাস নয়—তৃতীয় পক্ষ হিসেবে উঠছে ছোট ছোট সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা ত্রাণ ও প্রভাব-নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে নেমেছে। ইয়াসির আবু শাবাবের মতো স্থানীয় নেতা ও তাদের কর্মকাণ্ড শুধু গাজার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিই নয়, ইসরায়েলের কৌশলগত ভাবনাকেও নতুন মাত্রা দিচ্ছে।
ইসরায়েল অপরাধী চক্রের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের ত্রাণ লুটপাটে মদদ দেওয়ার নতুন কৌশল নিয়েছে।
এই দ্বন্দ্বে সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছেন সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণ—যাদের জন্য খাদ্য ও নিরাপত্তা আজ সবচেয়ে অধরা লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।