শেখ পরিবারের একচ্ছত্র শাসন থেকে দুই ভাইয়ের মনোনয়ন লড়াই: বাগেরহাটের রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া
রেল রোড থেকে সাধনার মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত এ পথ যেন বাগেরহাট শহরের প্রাণ। এক সময় ঈদের মতো বড় কোনো উৎসব এলেই এই রাস্তাঘাটের দেয়াল ও বিদ্যুতের খুঁটি ঢেকে যেত আওয়ামী লীগ নেতাদের পোস্টারে। এখন আর সে চেনা দৃশ্য নেই—দেয়ালে বদল এসেছে, বদল এসেছে রাজনীতির বাতাসেও।
শহরের রাজপথ থেকে শুরু করে অলিগলিতে এখন চোখে পড়বে দুই নেতার ছবি—একজন এম এ এইচ সেলিম, ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সমর্থিত সংসদ সদস্য; অন্যজন তারই ছোট ভাই এম এ সালাম, যিনি বাগেরহাট জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে বাগেরহাট-২ আসন থেকে প্রার্থী ছিলেন।
শহরের দেয়ালগুলো দুই ভাইয়ের পোস্টারে সয়লাব—অধিকাংশই লাগানো হয়েছে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের উদ্যোগে। দুজনের পোস্টারেই শোভা পাচ্ছে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি।
একই আসনে দুই ভাইয়ের মধ্যে বিএনপির মনোনয়ন কে পাবেন তা নিয়েই এখন জমে উঠেছে লড়াই।
এদিকে আলিয়া মাদ্রাসা রোড ও পিসি কলেজ এলাকার আশপাশে দেখা মিলছে কিছু নতুন মুখের পোস্টারও—যারা তুলনামূলকভাবে তরুণ এবং কম পরিচিত।
স্থানীয়দের ভাষ্য, গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা রাখার পর থেকেই এ তরুণ নেতারা আলোচনায় আসতে শুরু করেছেন। এরই মধ্যে এদের কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন নতুন গঠিত দল 'জাতীয় নাগরিক পার্টি' বা এনসিপিতে।
তবে চোখে পড়েনি জামায়াতে ইসলামী নেতাদের কোনো পোস্টার।
স্থানীয়রা বলছেন, এনসিপি কিংবা জামায়াত—এই দুই দলেরই তেমন ভিত্তি নেই বাগেরহাটে। রাজনীতির বাইরে থাকা সাধারণ মানুষজনের মধ্যেও একমাত্র বিএনপিই যে প্রভাব রাখছে, তা স্পষ্ট।
'এখনই যদি নির্বাচন হয়, তাহলে বিএনপি বিশাল ব্যবধানে জিতবে,' বলেন বাগেরহাট শহরের বাসিন্দা হামিদুল ইসলাম।
'আসলে নির্বাচনটা কেবল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র—ডিসেম্বরে হোক বা আগামী এপ্রিলেই, সেলিম হোক বা সালাম—বিএনপিই জিতবে। মনে হচ্ছে তারা এখনই ক্ষমতায় আছে', যোগ করেন তিনি।
তবে এমন কথা এক বছর আগেও ভাবা যেত না।
গত বছরের ঠিক একইসময়ে বাগেরহাটের দেয়ালজুড়ে সাঁটানো ছিল শেখ মুজিবুর রহমান, শেখ হাসিনা এবং আরেকটি পরিচিত মুখ—শেখ সারহান নাসের তন্ময় বা সবার পরিচিত শেখ তন্ময়ের ছবি।
মজার বিষয়, ২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন তন্ময় রাজনীতিতে ছিলেনই না।
২০১৮ সালে তৎকালীন বাগেরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময় হঠাৎ করেই রাজনীতিতে পা রাখেন। কোনো তৃণমূল রাজনীতির অভিজ্ঞতা বা নেতৃত্ব দিয়ে নয়, শুধু 'শেখ পরিবারের' সদস্য হওয়ার বদৌলতেই বাগেরহাট-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন। ২০১৮ ও ২০২৪ টানা দুই মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
বাগেরহাটসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতিতে একচ্ছত্র প্রভাব বজায় রেখেছিল এই শেখ পরিবার। এ পরিবার গড়ে উঠেছিল শেখ হেলাল, শেখ জুয়েল, শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল— এ পাঁচ ভাইকে ঘিরে। তারা সবাই ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের সন্তান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের সাথে শেখ আবু নাসেরও নির্মম হত্যাকাণ্ডে নিহত হন।
এই পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েল সংসদ সদস্য ছিলেন। তবে তাদের কেউই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে ছিলেন না। তবু এই অঞ্চল থেকে দলের কোনো পর্যায়ে উঠতে হলে, তাদের সম্মতি ছাড়া সেটা প্রায় অসম্ভব ছিল।
খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা বা ঝিনাইদহ—এই অঞ্চলের যেকোনো মনোনয়নপ্রত্যাশীকে যেতে হতো এই পরিবারের দরজায়। এমনকি মন্ত্রীরাও তাদের প্রভাব উপেক্ষা করতে সাহস করতেন না। বিশেষ করে পানিসম্পদ ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে তাদের কর্তৃত্ব ছিল দৃশ্যমান।
গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে স্থানীয় চাকরি, টেন্ডার [দরপত্র], বদলি এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি—সবকিছুতেই নাকি শেখ পরিবারের অঘোষিত নিয়ন্ত্রণ ছিল।
স্থানীয়দের কাছে এ প্রভাবচর্চা পরিচিত ছিল 'শেখ বাড়ি কোটা' নামে।
খুলনার শেরে বাংলা রোডে লাল বাউন্ডারির একটি দোতলা ভবনই ছিল সেই 'শেখ বাড়ি'। ঢাকায় বসবাস করলেও, খুলনায় এলে শেখ পরিবারের সদস্যরা এখানেই উঠতেন। আর তাদের উপস্থিতি মানেই বাড়িতে ভিড় করতেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ নানা মহলের মানুষ। এই বাড়িই হয়ে উঠেছিল এক অঘোষিত 'কমান্ড সেন্টার', যেখান থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো গোটা অঞ্চল।
কিন্তু এখন সেই বাড়ি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে—ধ্বংসস্তূপ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
গত বছরের ৪ ও ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার পতনের পর খুলনার 'শেখ বাড়ি' হামলার শিকার হয়। লুটপাটের পর আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় ভবনটিতে। এরপর চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারির রাতেও ফের চালানো হয় হামলা—বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দেয়ার পর আবারও জ্বালিয়ে দেয়া হয় ওই বাড়ি।
এক সময় যে বাড়িটি ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রতীক, এখন তা শুধুই পোড়া দেয়াল আর ধ্বংসস্তূপ। এক রাজনৈতিক রাজবংশের পতনের নিঃশব্দ সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসপ্রাপ্ত সেই 'শেখ বাড়ি'।
বাগেরহাট শহরের চিত্রও বদলে গেছে নাটকীয়ভাবে।
এক সময় যার ছবি ছাড়া কোনো দেওয়াল কল্পনাই করা যেত না, সেই শেখ তন্ময়ের একটি পোস্টারও আর দেখা যায় না। রাজপথ তো বটেই, মানুষের আলোচনাতেও তিনি অনুপস্থিত।
শোনা যায়, জনতার প্রতিশোধের ভয়ে তিনি ও তার বাবা-চাচারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
এখন দেশের অন্যান্য অনেক অঞ্চলের মতো, বাগেরহাটেও আগেভাগেই বইছে নির্বাচনী পরিবর্তনের হাওয়া।
রাজনৈতিক দৃশ্যপট যেদিকে যাচ্ছে, তাতে অন্তত আগামী পাঁচ বছর কিংবা তারও বেশি সময়ের জন্য এলাকার ভবিষ্যৎ অনেকটাই স্পষ্ট।
তবে সবচেয়ে নজরকাড়া বিষয় হতে পারে—যে দল এখানকার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করতে যাচ্ছে, তারা কীভাবে সামাল দেবে নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব, এমনকি তা যদি হয় দুই ভাইয়ের মধ্যেও।
মূল লেখা থেকে অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন
