বাজেট ২০২৫–২৬: ব্যবসায়ী মহলে স্পষ্ট অসন্তোষ

দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট নিয়ে স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, এই বাজেট বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। একদিকে বিনিয়োগ নেমে এসেছে এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে, অন্যদিকে আমদানি প্রবাহও কমে যাচ্ছে—এই প্রেক্ষাপটে শিল্পপতিরা আশা করেছিলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আস্থা পুনর্গঠনের জন্য সাহসী কোনো প্রণোদনা ঘোষণা আসবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন—দীর্ঘদিনের দাবি উপেক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি নতুন পদক্ষেপগুলো বিদ্যমান চাপ আরও বাড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক সিদ্ধান্তগুলোর একটি হলো টার্নওভার ট্যাক্স বৃদ্ধি—যা ০.৬০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কর লাভ-লোকসানের তোয়াক্কা না করে প্রদান করতে হয়, ফলে সীমিত মুনাফা, উচ্চ ঋণ খরচ এবং বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাসের মুখে থাকা ব্যবসাগুলোর জন্য এটি একটি অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। উদ্যোক্তারা একে 'শাস্তিমূলক' ব্যবস্থা হিসেবে বর্ণনা করেছেন—বিশেষ করে তাদের জন্য, যারা উন্নতির চেয়ে কেবল টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
রপ্তানি আয়ের প্রধান ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত পোশাক শিল্প মনে করছে, প্রস্তাবিত বাজেটে তাদের খাতটি উপেক্ষিত হয়েছে। বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা হ্রাস এবং যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে তুলা ও কৃত্রিম তন্তুর ওপর ভ্যাট আরোপকে সংশ্লিষ্টরা 'কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা'র মতো বলে মনে করছেন। যেখানে তারা স্বস্তির প্রত্যাশা করেছিলেন, সেখানে উল্টোভাবে নতুন ব্যয়ভার আরোপ করা হয়েছে।
কর্পোরেট মহলে আরও একটি গুরুতর উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়েছে—সংকীর্ণ করদাতা গোষ্ঠীর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। অথচ কর জাল সম্প্রসারণে নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ। একই সঙ্গে, মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও নতুন করে চাপের মুখে ফেলা হয়েছে। পরোক্ষ কর বৃদ্ধির বিপরীতে স্বস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা না থাকায় তাদের প্রকৃত আয় কমে যাবে, যা ভোক্তানির্ভর প্রবৃদ্ধির জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখা দিচ্ছে এবং পরোক্ষভাবে শিল্প উৎপাদন ও কর্মসংস্থানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
আলোচনার ভিড়ে পরিকল্পনার ঘাটতি
ব্যবসায়ী নেতারা অভিযোগ করেছেন, বাজেট ঘিরে শৃঙ্খলা ও সংস্কার নিয়ে যতই আলোচনা চলুক না কেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট একটি মৌলিক প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে—আন্তর্জাতিক ও দেশীয় অনিশ্চয়তার মধ্যে দাঁড়িয়ে সরকার কীভাবে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে চায়?
দেশের অন্যতম শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে বলেছে, তারা বর্তমান বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সংস্থাটির মতে, বাজেটে বিনিয়োগ পুনরুজ্জীবনের জন্য তেমন কোনো কার্যকর পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অথচ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিনিয়োগ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ২৯.৩৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
এক বিবৃতিতে এমসিসিআই জানিয়েছে, 'বিনিয়োগে স্থবিরতা কর্মসংস্থানের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে। সরকারি জটিলতা ও অপর্যাপ্ত অবকাঠামোর মতো বাধাসমূহ এই দুর্বল বিনিয়োগ পরিবেশকে আরও তীব্রতর করেছে, যার ফলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকট আরও গভীরতর হচ্ছে।'
'বাণিজ্য ও শিল্প উপেক্ষিত'
ইস্ট কোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বাণিজ্য ও শিল্প খাতের চাহিদা যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। তার ভাষায়, 'বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ হ্রাস পেয়েছে, অর্থের উচ্চ ব্যয় প্রবৃদ্ধি ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিকে ব্যাহত করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'বাজেটে নতুন বিনিয়োগ বা কর্মসংস্থান উৎসাহিত করতে কোনো অর্থবহ নীতিগত সহায়তা রাখা হয়নি। কাঁচামাল আমদানির ওপর শুল্ক এখনও উচ্চ রয়েছে, যা মুদ্রার অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আরও জটিল হয়ে উঠেছে। অথচ এই শুল্ক কাঠামো যুক্তিসংগত করতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।'
তার মতে, 'নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে কোনো নির্দিষ্ট শিল্পখাতকে অগ্রাধিকার হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়নি। অপরদিকে, ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণগ্রহণের ফলে ঋণের ব্যয় আরও বাড়তে পারে, যা উৎপাদনশীল বেসরকারি বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে।'
'আইএমএফের দেখানো পথেই বাজেট'
বাংলাদেশ চেম্বার অফ ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেছেন, এবারের বাজেট আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর নির্দেশনা অনুসরণ করেই প্রস্তুত করা হয়েছে। তার মতে, 'আমরা যদি আইএমএফের নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করি, তাহলে আমাদের শিল্পখাত বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে।'
তিনি বলেন, 'জ্বালানির দাম বৃদ্ধি, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদের হার এবং অপর্যাপ্ত জ্বালানি সরবরাহের কারণে খরচ ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। এমনকি যেসব শিল্প প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে ছিল, সেগুলোও এখন বাড়তি শুল্ক ও করের চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।'
'উৎপাদন পর্যায়ে তুলা ও কৃত্রিম তন্তুর সুতার ওপর ভ্যাট কেজিপ্রতি ৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলমান জ্বালানি সংকটের প্রেক্ষাপটে এই করবৃদ্ধি দেশীয় স্পিনিং মিলগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে এবং বস্ত্রখাতকে আমদানিনির্ভরতার দিকে ঠেলে দেবে,' বলেন তিনি।
চৌধুরী আরও বলেন, ইস্পাত শিল্পের জন্য কাঁচামালের ওপর শুল্ক ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে, সিমেন্ট শিল্পে কাঁচামালের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করায় আবাসন ও নির্মাণ খাতে ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাবে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) কয়েকটি ইতিবাচক দিককে স্বাগত জানালেও কিছু গুরুতর উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছে, যা তাদের মতে দেশের ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে।
প্রধান উদ্বেগগুলোর মধ্যে একটি হলো, যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানির পাবলিক শেয়ারহোল্ডিং ১০ শতাংশের কম, তাদের ওপর ৭.৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর্পোরেট কর আরোপ। ফিকি একে বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। একই সঙ্গে তারা ব্যাংক লেনদেনভিত্তিক ব্যবসার জন্য প্রযোজ্য হ্রাসকৃত করহার প্রত্যাহারের সমালোচনা করে সতর্ক করেছে যে, এ সিদ্ধান্ত নগদহীন অর্থনীতির পথকে দুর্বল করতে পারে।
ফিকি অনলাইন বিক্রির ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করাকেও উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছে। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্ত ই-কমার্স খাতের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে।
এছাড়া, কর কাঠামোর পরিবর্তনে মধ্যম আয়ের বেতনভোগীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হতে পারে, যদিও করমুক্ত আয়ের সীমা সামান্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমদানিকারকদের ওপর ৭.৫ শতাংশ অগ্রিম কর আরোপ, নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া সহজ করা হলেও, মূল্য সংযোজন কম হলে এটি ব্যয়বৃদ্ধির কারণ হতে পারে বলেও ফিকি মত দিয়েছে। তারা আরও উল্লেখ করেছে, রিবেট বা রিফান্ডে বিলম্ব কার্যকরী মূলধন এবং ব্যবসার গতিশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) বলেছে, প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, ব্যবসা সহজীকরণ, সিএমএসএমই এবং ব্যাংকিং খাতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনার অভাব রয়েছে। তাদের মতে, এসব ঘাটতি ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সহায়ক পরিবেশ গঠনে অন্তরায় হতে পারে।
বাজেট ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর ডিসিসিআই সভাপতি তাসকিন আহমেদ চেম্বারের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ন্যূনতম করহার সমন্বয়, অনুমোদিত কর্তনের বিস্তৃত সুযোগ এবং একটি স্বয়ংক্রিয় রিটার্ন সিস্টেম চালুর মতো কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও, ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ অনুপস্থিত।
বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্ট (বিল্ড)-এর চেয়ারপারসন আবুল কাশেম খান বাজেট নিয়ে স্বীকৃতি ও সমালোচনার মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তার মূল উদ্বেগের বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে কর কাঠামোর অসামঞ্জস্যতা, বাজেট বাস্তবায়নের দুর্বলতা এবং রপ্তানিকারক ও অনলাইন উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা।
তিনি বলেন, 'তুলা ও কৃত্রিম তন্তুর ওপর নতুন কর রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের নীতিগত লক্ষ্যকে ব্যাহত করবে। এই কর রপ্তানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে দুর্বল করে দিতে পারে—বিশেষ করে যেখানে বিল্ড দীর্ঘদিন ধরে রপ্তানি খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করার লক্ষ্যে কাজ করে আসছে।'
তুলা এবং কৃত্রিম তন্তুর ওপর ভ্যাট ও কর বৃদ্ধির তীব্র সমালোচনা করেছেন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি)-এর চেয়ারম্যান ও অনন্ত অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহির। তিনি বলেন, 'শিল্পখাত ইতোমধ্যে বৈশ্বিক চাহিদা হ্রাস, জ্বালানির নিরাপত্তাহীনতা ও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কবৃদ্ধির মতো বহুমুখী চাপে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে শিল্প খাতকে স্বস্তি দেওয়ার প্রয়োজন ছিল—নতুন বোঝা নয়।'
স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের কৌশলগত প্রস্তুতি বাজেটে অনুপস্থিত বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ-থাইল্যান্ড চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি শামস মাহমুদ। তার অভিযোগ, বাজেট প্রণয়নে বেসরকারি খাতের অগ্রাধিকারগুলোর প্রতি যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। একই সঙ্গে তিনি করনীতিকে প্রতিকূল বলে আখ্যা দেন এবং বলেন, বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে উত্তরণের পথে, তখন দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতির অভাব স্পষ্ট। ব্যবসা ও বিনিয়োগকে প্রভাবিত করতে পারে—এমন বহু কর-বহির্ভূত বিষয়ে বাজেটে কার্যকর নির্দেশনার অভাব রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
অন্যদিকে, উন্নত সরবরাহ ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচ্যাম)-এর সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ। তিনি কর কাঠামোর উন্নয়নের প্রচেষ্টা স্বীকার করলেও জোর দিয়ে বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ সম্ভব নয়। একইসঙ্গে তিনি শুল্ক প্রক্রিয়ার জটিলতা তুলে ধরে বলেন, এখনো একটি পণ্য খালাসে ১৭টি স্বাক্ষরের প্রয়োজন হয়, যা ব্যবসা পরিচালনায় বড় অন্তরায়। ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতে সরবরাহ ব্যবস্থার দ্রুত উন্নয়ন অপরিহার্য বলেও তিনি মন্তব্য করেন।