পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে ফিল্ড মার্শালে পদোন্নতি, কী এর তাৎপর্য

পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছে দেশটির মন্ত্রিসভা। সাম্প্রতিক সময়ের ভারত-পাকিস্তান সামরিক সংঘাতের পর গতকাল মঙ্গলবার এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দুই দেশের মধ্যে চলতি মে মাসের শুরুতে চারদিন ধরে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার মধ্য দিয়ে তীব্র সামরিক সংঘাত হয়েছে। এমনকী ১৯৪৭ সালের পরে এটি ভারত-পাকিস্তানের পঞ্চম যুদ্ধে রূপ নিতে পারত।
তবে ১০ মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশই সংঘাত থেকে সরে আসে। ওইদিন উভয় পক্ষই একে অপরের সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছিল।
নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ উভয়ই এই সংঘাতে নিজেদের বিজয় দাবি করেছে। পাকিস্তান সরকার সরাসরি এই সংঘাতের সাফল্যকেই মুনিরের পদোন্নতির পেছনের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
কেন আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল করা হলো?
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করার প্রস্তাব দিলে মন্ত্রিসভা তা অনুমোদন করে।"
এছাড়া বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল জহির আহমেদ বাবর সিদ্দিকীর মেয়াদও ফের এক দফা বাড়ানো হয়েছে।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তালাল চৌধুরী আল জাজিরাকে বলেন, "পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দুই ফ্রন্টে লড়াই করতে হচ্ছে—একদিকে পশ্চিম সীমান্তে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, আর অন্যদিকে পূর্ব সীমান্তে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবু মুনিরের নেতৃত্বে আমরা নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয়েছি।"
মুনিরের প্রতিক্রিয়া?
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণমাধ্যম শাখা আইএসপিআর-এর এক বিবৃতিতে মুনির বলেন, "এটি কোনো ব্যক্তিগত সম্মান নয়, বরং পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ও পুরো জাতির জন্য সম্মান। আমি এটি শহীদ ও বীর সেনানীদের প্রতি উৎসর্গ করছি।"
ফিল্ড মার্শাল পদটি সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ, যা পাকিস্তান ও ভারতের মতো ব্রিটিশ সামরিক ঐতিহ্য অনুসরণকারী দেশে বিরল ক্ষেত্রেই জেনারেলদের বরাতে জুটেছে।
ফিল্ড মার্শাল পদ কতটা বিরল?
খুবই বিরল।
সাধারণত চার তারকা জেনারেলই পাকিস্তানে সেনাপ্রধান ও জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান পদে আসীন হন। ১৯৯৭ সাল থেকে এই পদে কেবল সেনাবাহিনীর জেনারেলরাই নিয়োগ পেয়ে আসছেন।
স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তানে ১৭ জন সেনাপ্রধান হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেবল দুইজনই — ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত হয়েছেন। প্রথমজন ছিলেন আইয়ুব খান, যিনি ১৯৫১ সালে সেনাপ্রধান হন এবং ১৯৫৮ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর নিজেই নিজেকে ফিল্ড মার্শাল ঘোষণা করেন।
আইনজীবী ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা ইনাম উল রাহিম আলজাজিরাকে বলেন, "ফিল্ড মার্শালদের নিজস্ব ব্যাজ ও স্টিক থাকে। তারা স্যালুটের জবাবে স্যালুট দেন না, বরং স্টিক নাড়িয়ে উত্তর দেন।"
একবার এই পদ পেলেই তা আজীবনের জন্য বহাল থাকে।
ভারতেও কি ফিল্ড মার্শাল পদ আছে?
হ্যাঁ, এবং সেটিও খুব বিরল। স্বাধীনতার পর ভারত মাত্র দুইজন সেনা কর্মকর্তাকে ফিল্ড মার্শাল উপাধিতে ভূষিত করেছে।
প্রথম ছিলেন স্যাম মানেকশ, যিনি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধ জয়ের পর ইন্দিরা গান্ধী তাকে ফিল্ড মার্শাল উপাধি দেন। দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিলেন কে এম কারিয়াপ্পা, যিনি ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৮৬ সালে পদটি পান।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কতটা ক্ষমতাধর?
দেশটির সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচিত হয় সেনাবাহিনী। ১৯৪৭ সালের পর থেকে তিন দশকের বেশি সময় সরাসরি দেশ শাসন করেছে সেনাবাহিনী।
সেনাপ্রধানকে পাকিস্তানের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে দেখা হয়। নির্বাচিত সরকারকে ছাপিয়ে তাদের প্রভাব দীর্ঘদিন ধরেই দৃশ্যমান। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগও রয়েছে।
২০২২ সালে বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া তার শেষ বক্তব্যে স্বীকার করেন যে, সেনাবাহিনী অতীতে রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছে, তবে তিনি দাবি করেন, এখন সেই যুগ শেষ।
তবে বর্তমান সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের সময়ে, ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) অভিযোগ করেছে, সেনাবাহিনী তাদের দলের নেতাদের ওপর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগও তুলেছে তারা। যদিও বর্তমান সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
অন্যদিকে মুনিরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী সরাসরি অর্থনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। ২০২৩ সালে গঠিত স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন কাউন্সিলের (এসআইএফসি) সহ-সভাপতি মুনির, যা বিনিয়োগে প্রশাসনিক জটিলতা কমানোর লক্ষ্যে কাজ করে।
আসিম মুনিরের সময়েই পাকিস্তানের অর্থনীতিতে কিছুটা গতি ফিরেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে, এবং ২০২৩ সালের মে মাসে ৩৮ শতাংশ ছুঁয়ে ফেলা মূল্যস্ফীতি— এবছরের এপ্রিল নাগাদ কমে ০.৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
ইমরান খানের সমর্থকদের সমালোচনার কারণে সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা কিছুটা কমে গেলেও ভারত-পাকিস্তান সাম্প্রতিক সংঘাতে সেই ভাবমূর্তি আবার উজ্জ্বল হয়েছে।
এই পদোন্নতির রাজনৈতিক তাৎপর্য কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফিল্ড মার্শাল পদটি মূলত প্রতীকী হলেও এর মাধ্যমে মুনিরের মেয়াদ বাড়ানোর সম্ভাবনা জোরালো হয়েছে।
লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস) এর শিক্ষিকা মারিয়া রশিদ বলেন, "এই পদোন্নতি প্রায় নিশ্চিত করছে যে, আসিম মুনির তার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও— দ্বিতীয়বারের মতো পাঁচ বছরের জন্য সেনাপ্রধানের পদে থাকতে পারেন।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সিরিল আলমেইদা মনে করেন, এই পদোন্নতির পেছনে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও রয়েছে।
তিনি বলেন, "এটি মূলত শাহবাজের পক্ষ থেকে একটি বার্তা — তিনি সেনাবাহিনীর জন্য কোনো হুমকি নন, তাই তাকে সরিয়ে দেওয়ার দরকার নেই।"
সমালোচকরা বলছেন, মুনিরের পদোন্নতি সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব আরও জোরদার করতে পারে। তবে প্রতিমন্ত্রী তালাল চৌধুরী এসব অভিযোগ নাকচ করে দেন।
তিনি বলেন, "আমরা যুদ্ধ করেছি এবং জিতেছি। যারা সেনাবাহিনীর সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাদের জন্য এটাই আমাদের জবাব। মুনিরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী তার যোগ্যতা ও পেশাদারিত্ব প্রমাণ করেছে।"