করিডর নিয়ে 'কোনো আলোচনা হয়নি', ত্রাণ 'চ্যানেল' দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনায়: খলিলুর রহমান

করিডর নিয়ে 'কোনো আলোচনা হয়নি', ত্রাণ 'চ্যানেল' দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।
তিনি বলেন, ''বাংলাদেশ 'করিডর' নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রাণ সরবরাহের একটি 'চ্যানেল' তৈরির জাতিসংঘের প্রস্তাব বাংলাদেশ বিবেচনা করছে।''
আজ (২১ মে) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন তিনি। এসময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
এসময় জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ''জাতিসংঘের সাহায্য নিয়ে বাংলাদেশে একটি করিডর দেওয়ার যে গুজব তৈরি হয়েছে, দ্ব্যার্থহীনভাবে বলতে চাই করিডর নিয়ে আমরা কারো সঙ্গে কথা বলিনি। যেহেতু আরাকানে এইড ও অন্যান্য উপকরণ সাপ্লাই দেওয়া যাচ্ছেনা, তাই জাতিসংঘ সেখানে তার বিভিন্ন সহযোগীদের মাধ্যমে রাখাইনে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতে চায়। জাতিসংঘকে জিজ্ঞেস করেন, আমরা করিডর নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলিনি, বলব না।''
তিনি বলেন, ''করিডরের প্রয়োজনীয়তা নেই। যেটা প্রয়োজন আছে সেটা হচ্ছে ত্রাণ-সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।''
তিনি আরও বলেন, ''মানবিক করিডর নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। যার অস্তিত্ব নেই তা নিয়ে কীভাবে কারো সঙ্গে কথা বলা যায়।''
খলিলুর রহমান বলেন, ''এই ব্যাপারটা নিয়ে বহু কিছু বিবেচনা করা হচ্ছে। শুধু সরকার না দেশের সব অংশীদারদের নিয়ে আলোচনা করে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। কোনো কিছুই এখনও বিবেচনার পর্যায়ে আসেনি। বিবেচনার পর্যায়ে আসলে তখন আমরা সবার সঙ্গে কথা বলব।''
খলিলুর রহমান বলেন, ''আরাকান আর্মি যদি 'এথনিক ক্লিনজিং'- এর পলিসি নেয় তাহলে তাদের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য হবে না। আপনাদেরকে সবিনয়ে বলতে চাই, কোনো রাষ্ট্রই পাবলিক ডিপ্লোম্যাসির মধ্যে হয়না। সবকিছু ডিসক্লোজ করা যায় না।''
তিনি বলেন, ''করিডর হলে সেটার পুরো কন্ট্রোল থাকবে জাতিসংঘের। আমরা চেষ্টা করব বর্ডার কন্ট্রোলের, কনফ্লিক্ট এড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। মিয়ানমার আর্মি এয়ার স্ট্রাইক বন্ধ না করলে সেটা বিবেচনার সুযোগ নেই।''
আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা সম্মেলন নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ''গত সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা এই ইস্যু তুলেছিলেন। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করার আহ্বান জানিয়েছিল। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতে সোৎসাহে সাড়া দিয়েছে।নজাতিসংঘ আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। মোট ১০৬টি দেশ এটি স্পন্সর করবে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সচিবালয়ে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে।''
নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ''করিডরের প্রচারণা বাংলাদেশ থেকে হয়নি। এটি প্রতিবেশী দেশের একটি মিডিয়া থেকে এসেছে। এমনকি তারা প্রচার করছে যে আমরা আমেরিকার পক্ষ থেকে প্রক্সি যুদ্ধ করব। কিন্তু এগুলো সব অবাস্তব ও মিথ্যা। আমরা ভেবেছিলাম বুদ্ধিমানরা এসবের বিরুদ্ধে বলবে।সরকার সব কথা বলবে কেন।''
এক প্রশ্নের জবাবে নিরাপত্তা উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, ''মিয়ানমার ইস্যুতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের কোনো মতপার্থক্য নেই। এই ব্যাপারে আমরা সবাই এক সমতলে। সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ফরেন অফিসের সঙ্গে আমরা কো-অর্ডিনেশন নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমি খুব ক্লোজলি কাজ করছি।''
তিনি আরও বলেন, ''আমেরিকার চাপের মধ্যে আমরা নেই। আমরা কারো চাপের মধ্যেই নেই। আমরা আমেরিকা-চীন সবার সঙ্গেই কথা বলছি। যেই চাপ নেই সেটার কোনো ভারও নেই।''
খলিলুর রহমান বলেন, ''আমরা কোনো তাড়াহুড়োর মধ্যে নেই। আমরা চাই প্রত্যাবাসন। আজকে তারা ফেরত গেলেন, আবার হত্যার শিকার হয়ে চলে আসলো সেটা আমরা মেনে নেবোনা। আমরা চাই সাস্টেইনবেনল প্রত্যাবাসন।''
তিনি বলেন, ''আরাকানের ৯০ ভাগ এলাকা দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। তাই সমান্তরালে আলোচনা চালু করেছি। আমাদেরকে আরাকান আর্মি স্পষ্টভাবে বলেছে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া আমাদের একটা প্রিন্সিপাল পজিশন। পরিস্থিতির উন্নতি হলে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিবে।''
তিনি আরও বলেন, ''আরাকানের অবস্থা যতদিন অস্থির থাকবে ততদিন প্রত্যাবাসন নিয়ে কথা বলব না। প্রত্যাবসনের কোনো পূর্বাবস্থা তৈরি হয়নি সেখানে।''
খলিলুর রহমান বলেন, ''আমরা প্রথম থেকেই ভেবেছি যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা একমাত্র সমাধান। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক কনসেনশাস এসেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বলেছেন মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করাই একমাত্র সমাধান। এই কাজটি করার সকল অপশন আমাদের টেবিলে থাকবে। আমাদের সকল কূটনৈতিক ও অন্যান্য প্রচেষ্টা দিয়ে এই সমস্যা সমাধান করতে হবে।''
তিনি বলেন, ''আজ অব্দি প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে আছে। এই সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর এই ইস্যুকে আন্তর্জাতিক এজেন্ডা হিসেবে তুলা ধরার চেষ্টা করেছে। গত ৭ বছর এই ইস্যু অপসৃত ও পেছনে পড়ে গিয়েছিল।''
বিগত সরকারের ভূমিকা নিয়ে তিনি বলেন, ''বাংলাদেশের তরফ থেকে এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল কি না। ইস্যুটা তো মরেই গিয়েছিল। আমাদের তরফ থেকেই কোনো উদ্যোগ ছিল না।''
করিডোর নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে খলিলুর রহমান বলেন, ''উনি যেটা বলেছিলেন করিডর শব্দ ব্যবহার করেই কারেক্ট করেছিলেন, সেটা স্লিপ অব টাঙ ছিল।''
নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, ''মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে ব্যাপক খাদ্যাভাব ও ওষুধের অভাব দেখা দিয়েছে। ইউএনডিপির রিপোর্ট অনুসারে সেখানে ভয়াবহ মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। এতে আরও রোহিঙ্গা এদেশে চলে আসতে পারে। আমরা আমাদের ভার ধারণের সীমার বাইরে চলে এসেছি। অতিরিক্ত শরণার্থী আর গ্রহণ করা সম্ভব নয় এটা জানিয়েছি।''
তিনি বলেন, ''অতিরিক্ত খাদ্যাসংকটে রাখাইনের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষও আমাদের সীমান্তে চলে আসছে। তারা চলে আসলে আরও সংকট তৈরি হবে। নতুন সংকট তৈরি হবে।''
খলিলুর রহমান বলেন, ''জাতিসংঘের মহাসচিব আমাদের বললেন আমরা রাখাইনে ত্রাণ সহায়তা দিতে পারি কি না। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে রাখাইন আর্মিকে জানানো হয়েছে এটার প্রাপ্তি ও বিতরণের ব্যাপারে কািউকে বঞ্চিত করা যাবেনা। যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করা যাবে না।''
তিনি বলেন, আমরা জানিয়েছি আরাকান প্রশাসনে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি না। আমরা কোনো ধরনের নতুন এথনিক ক্লিঞ্জিং চাচ্ছি না। আরাকান আর্মি এপার্থেইড রাষ্ট্র কায়েম করতে চাইলে আমরা কেন সাহায্য করব তাদের?''
তিনি আরও বলেন, ''রোহিঙ্গাদের সংখ্যা কত এটা বায়োমেট্রিক করে থাকে ইউএনএইচসিআর। তাদের সঙ্গে আমাদের একটা এমওইউ ছিল। রোহিঙ্গাদের হাতের ছবি ও মুখের ছবি তাদের সংরক্ষণে ছিল। আগের সরকার সেই তথ্যই চায়নি। আমরা এখন সেই তথ্য নিয়ে আমাদের ডাটাবেজ এ মেলাব। এতেই বোঝা যাবে কত রোহিঙ্গা পাসপোর্ট পেয়েছে, বাইরে গেছে।''
নিজের নাগরিকত্বের প্রসঙ্গে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেন, ''আমার একটাই সিটিজেনশিপ, বাংলাদেশি। বাংলাদেশ ছাড়া আমার অন্য কোনো দেশের পাসপোর্ট নেই। আমি জাস্ট আমেরিকায় ছিলাম, বাংলাদেশ ছাড়া কোনো দেশের পাসপোর্ট নেই। আরেক দেশে অবস্থান করার কারণে সেদেশের নাগরিকত্বের কথা বললে তো তারেক জিয়ার ওপরেও প্রশ্ন চলে আসবে।''
তিনি বলেন, ''আমার অন্য দেশের নাগরিকত্ব নেই, থাকলে আপনারা প্রমাণ করেন।''