রায় পক্ষে এলেও উপদেষ্টা আসিফ পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে: ইশরাক

আদালতের রায় পক্ষে এলেও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন।
আজ বুধবার রাত ১০টার দিকে কাকরাইল মোড়ে বিক্ষোভরত নেতা-কর্মীদের সাথে অবস্থানকালে তিনি সাংবাদিকদের এ কথা বলেন। এর আগে সন্ধ্যায় তিনি বিক্ষোভে যোগ দেন।
ইশরাক বলেন, 'মেয়র হওয়ার জন্য কিংবা ব্যক্তি ক্ষমতার জন্য আমি এখানে আসিনি। আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া একটি দলের হয়ে কাজ করেছেন, নির্বাচন কমিশন ও আদালতে হস্তক্ষেপ করেছেন। তিনি নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন। আমরা অবিলম্বে তার পদত্যাগ চাই। যদি আদালতের রায় আমাদের পক্ষে পাইও সেটা হবে আইনের শাসনের বিজয় হয়েছে, এর বেশি কিছু না। তবে আমরা আসিফের পদত্যাগ ছাড়া অবরোধ ছাড়ছি না।'
তিনি আরও বলেন, ১একটা সাধারণ জিনিস চারদিন ধরে কোনো সুরাহা হচ্ছে না। তারা বারবার আদালতের ওপর হস্তক্ষেপ করছেন। দেশের জনগণের ভোটের ওপর আস্থা আসুক এজন্যই আমরা মাঠে নেমেছি।'
'এ আন্দোলন ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য, পেছনে ফেরার সুযোগ নেই'
বিক্ষোভে অংশ নিয়ে ইশরাক বলেন, 'আজকের এই আন্দোলন শুধু এক ব্যক্তি ইশরাক হোসেনের জন্য নয়। এই আন্দোলন ডিসেম্বরের মধ্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ও নির্বাচনের ভোট সঠিকভাবে গণনার জন্য।'
তিনি এও বলেন, 'আমাদের পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। আমাদের দাবি মানা না হলে আমরা ঘরে ফিরব না। আমি সবাইকে বলব আপনারা আপনাদের ভোটের অধিকার ফিরে চান।'
মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ প্রসঙ্গে ইশরাক বলেন, 'আদালতের রায়ের মাধ্যমে আমি যে মামলা করেছিলাম, সেই মামলার রায় পেয়েছি, এখন আইন অনুযায়ী আমার এতদিনে শপথ নেওয়ার কথা, কিন্তু তারা সেটা দিচ্ছে না।'
তিনি অভিযোগ করে বলেন, 'আমার ঘটনা দিয়ে যে বিষয়টি দেখতে পেলাম সরকারের ভেতর থেকে বিচার বিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনকে আজ একপ্রকার জিম্মি করা হয়েছে।'
'এখন আপনারা কি আশা রাখতে পারেন নিরপেক্ষভাবে জাতীয় নির্বাচন হবে এই সরকার থাকা অবস্থায়?', প্রশ্ন রাখেন বিএনপির এই নেতা।
তিনি আরও বলেন, 'হাসিনার আমলেও একই কাজ হয়েছিল। বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ করেছে, নির্বাচন কমিশনকে ধ্বংস করেছে, প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেছে। আমরা কি আরেকটি স্বৈরশার তৈরি হতে দিতে পারি? আর কোনো স্বৈরাচার এই বাংলার মাটিতে হতে দেব না। আর যদি হয়ও হাসিনার মতোই পরিণতি হবে। আমরা ১৭ বছর নির্যাতন সহ্য করে খুনি হাসিনার পলায়নের প্রেক্ষাপট তৈরি করছিলাম। আমরা যেকোনো সময় উচিত জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছি।'
'সরকারের নিরপেক্ষতার জন্য উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের পদত্যাগ করা উচিত'
সরকার তাদের নিরপেক্ষতা কীভাবে ফেরত পেতে পারে, সেটার জন্য তাদের পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান ইশরাক। তিনি বলেন, 'আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সরকারের প্রথম কাজটি হচ্ছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার পদত্যাগ করতে হবে। এরপর আরেক ছাত্রনেতা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকেও পদত্যাগ করতে হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুজন উপদেষ্টার সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, কোনো শত্রুতাও নেই। আমি উনাদের জন্য শুভ কামনা করি। উনারা পদত্যাগ করে যে রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে চান সেখানে গিয়ে সাংগঠনিক রাজনীতি করেন। সরকারের ওপর আর হস্তক্ষেপ চলবে না। এটা আমরা হতে দেব না। আমরা সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনের রোডম্যাপ চাই।'
এর আগে আজ সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে করা এক পোস্টেও একই আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।এ সময় তিনি অবস্থানরত আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা পোষণ করে আন্দোলনে নিজেও অবস্থান নেবেন বলে ঘোষণা দেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটির নগর ভবন, মৎস ভবন মোড় ও কাকরাইলে সড়ক অবরোধ
ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে আজ ঢাকা দক্ষিণ সিটির নগর ভবনের পাশাপাশি মৎস্য ভবন মোড় ও কাকরাইলে সড়ক অবরোধ করেন তার সমর্থকেরা।
বেলা ১১টার পর মৎস্য ভবন মোড় অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাস্তায় কয়েক হাজার বিএনপি নেতাকর্মীরা ইশরাককে মেয়র হিসেবে শপথ দিতে স্লোগান দিতে থাকেন।
ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সদস্য মো. মশিউর রহমান বলেন, 'আজকে যদি ইশরাক হোসেনকে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে না দেওয়া হয়, প্রয়োজনে আমরা আদালত ঘেরাও করতে বাধ্য হবো।'
তিনি বলেন, 'এখন আমরা প্রধান উপদেষ্টার বাস ভবনের কাছে কাকরাইল আছি। দাবি আদায়ে আমরা তার বাস ভবনের সামনেও অবস্থান নিতে পারি। উপদেষ্টা আসিফ আর পদে থাকার নৈতিকতা হারিয়েছে। তার উচিত পদত্যাগ করা। সে সরকারে থেকে রাজনীতি করে, এটা হবে না।'
এদিকে, সমর্থকদের উদ্দেশ্যে রাজপথ ছেড়ে না আসার নির্দেশনা দিয়েছেন ইশরাক হোসেন।
আজ বেলা দুইটার দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এ নির্দেশনা দেন তিনি।
এক লাইনের ওই পোস্টে তিনি লিখেছেন, 'নির্দেশ একটাই যতক্ষণ দরকার রাজপথ ছেড়ে উঠে আসা যাবে না।'
এদিকে, ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র হিসেবে ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া গেজেটের বৈধতা নিয়ে এবং শপথ পড়ানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা চেয়ে রিটের আদেশ পিছিয়ে বৃহস্পতিবার (২০ মে) দিন ধার্য করা হয়েছে।
বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ দুপুর সোয়া ১টার পর এই আদেশ দেন।
এর আগে, আদালতের রায় দেখে নগর ভবনের সামনে থেকে কর্মসূচি নির্ধারণ করা হবে বলে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, গত ২৭ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন আইন মন্ত্রণালয়ের আইনি মতামত পাওয়ার পর এবং পরবর্তীতে গেজেট প্রকাশের পর ইশরাককে ঢাকা দক্ষিণের নতুন মেয়র ঘোষণা করে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের সব মেয়রকে অপসারণ করা হয়।

১৭ মে এক সংবাদ সম্মেলনে ইশরাক বলেন, নির্বাচনের ৩০ দিনের মধ্যে তিনি একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। 'ঢাকা দক্ষিণের তৎকালীন মেয়র তাপস জোর করে মামলার কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করেছিলেন,' বলেন তিনি।
ইশরাক আরও বলেন, 'সে সময় আদালত আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল। আমরা সব আইনি পদক্ষেপ অনুসরণ করে রায় পেয়েছি। যারা রায়ের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, তারা আদালতকে অপমান করছেন।'
গেজেট প্রকাশের ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও তাকে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হিসেবে শপথ গ্রহণ করানো হয়নি উল্লেখ করে ইশরাক বলেন, তিনি শপথ নিতে প্রস্তুত।
ইশরাকের সমর্থকদের অভিযোগ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া ইচ্ছাকৃতভাবে শপথ গ্রহণে বাধা দিচ্ছেন। তাদের মতে, 'আইনগত জটিলতা', 'অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা', 'মন্ত্রণালয়ের মতামত' ইত্যাদি দেখিয়ে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। তারা উপদেষ্টার অপসারণসহ ইশরাকের শপথে আর বিলম্ব না করার দাবি জানাচ্ছেন।

২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়। তাতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস মেয়র নির্বাচিত হন। নির্বাচন কমিশন ২ ফেব্রুয়ারি ভোটের ফলের গেজেট প্রকাশ করে।
এরপর শপথ নিয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তাপস। সেই নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র পদে তাপস পেয়েছিলেন সোয়া চার লাখ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ইশরাক পান দুই লাখ ৩৬ হাজার ভোট। নির্বাচনে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ২০২০ সালের ৩ মার্চ মামলা করেন ইশরাক।
ছাত্র আন্দোলনের পর গত বছরের আগস্ট মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সিটি করপোরেশনের মেয়রদের অপসারণ করা হয়। এরপর ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন অতিরিক্ত সচিব শাহজাহান মিয়া।

এর মধ্যে গত ২৭ মার্চ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২০২০ সালের নির্বাচনে ফজলে নূর তাপসকে বিজয়ী ঘোষণার ফল বাতিল করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করেন ঢাকার প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. নুরুল ইসলাম।
আদালত ১০ দিনের মধ্যে গেজেট প্রকাশের নির্দেশ দেন। এ রায় পাওয়ার পর ২৭ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।
এদিকে, সরকার গায়ের জোরে ইশরাক হোসেনকে মেয়র হতে দিচ্ছে না বলে গতকাল (২০ মে) মন্তব্য করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, 'আদালতের রায় ঘোষণার পরও ইশরাক হোসেনকে শপথ নিতে দেওয়া হচ্ছে না। এতে সরকার গায়ের জোর খাটাচ্ছে।'

মঙ্গলবার (২০ মে) রাজধানীর খিলক্ষেতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত রাকিবুল হাসানকে দেখতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'চট্টগ্রামে ডা. শাহাদাত যদি মেয়র হতে পারেন, তাহলে ইশরাক কী দোষ করলেন? সরকার জোর করে তাকে মেয়র হতে দিচ্ছে না।'
তিনি আরও বলেন, 'স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার বয়স অনেক কম। হঠাৎ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পেয়ে গেছেন। এ জন্য তার কথাবার্তায় ভারসাম্যহীনতা রয়েছে।'