অব্যবস্থাপনায় শেষ হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আর্থিক হিসাব

ব্যাপক অব্যবস্থাপনার মধ্যে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের আর্থিক হিসাব শেষ করতে হচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনকে (ডিএসসিসি)। ডিএসসিসির মেয়র-সংক্রান্ত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হওয়া অচলাবস্থার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এ অবস্থায় একদিকে শেষ হওয়া অনেক উন্নয়ন কাজের বিল অনুমোদন করা সম্ভব হচ্ছে না বা অসম্পূর্ণ অবস্থায় নিষ্পন্ন করতে হচ্ছে। আবার অনেক কাজের যথাযথ যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিল অনুমোদন করতে হচ্ছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষকে।
বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে বিএনপির নেতাকর্মী ও সিটি করপোরেশনের কিছু কর্মচারীর আন্দোলনে ৪০ দিন নগর ভবনে সেবা কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
গত ১৪ মে থেকে নগর ভবনের প্রধান ফটকে তালা লাগিয়ে মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন ইশরাক হোসেন ও তার সমর্থকরা। টানা ৪০ দিন বন্ধ থাকার পর অবশেষে ২৩ জুন খুলেছে ডিএসসিসির প্রধান কার্যালয়। যদিও এখন পর্যন্ত প্রকৌশল বিভাগ ও প্রশাসকের দপ্তরে কোনো কার্যক্রম হচ্ছে না।
এ আন্দোলনের কারণে সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সেবা, রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম, উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন ও তার বিল পরিশোধে এক ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়।
এতে সিটি কর্পোরেশন যেমন আর্থিক হিসাব মেলাতে সমস্যায় পড়ছে, তেমনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ একাধিক মন্ত্রণালয়ও তাদের অর্থবছরের ব্যয়ের হিসাব মেলাতে সমস্যায় পড়েছে। কারণ ঢাকা দক্ষিণ সিটির মাধ্যমে এসব মন্ত্রণালয়ের কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, যেখানে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়ন রয়েছে।
এমনকি স্থানীয় সরকার বিভাগের কার্যক্রমও ব্যাহত হয়েছে। কারণ সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে গত ডিসেম্বরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে স্থানীয় সরকার বিভাগ ডিএসসিসির কয়েকটি ফ্লোরে অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। এই আন্দোলনে স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মীরাও সেখানে অফিস করতে পারেননি।
চলতি অর্থবছরে ডিএসসিসি নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুৎ, জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ, জলবায়ু ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি (আইসিটি) উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
বিল নিষ্পত্তি ও চেক ইস্যু জটিলতা
অর্থ বিভাগ থেকে ২২ মে এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের আওতায় অর্থ অবমুক্তির জন্য ১৭ জুন পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। নতুন ব্যয় বিল দাখিল করা যাবে সর্বশেষ ২২ জুন পর্যন্ত।
পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় বিল নিষ্পত্তি ও চেক ইস্যুর সর্বশেষ তারিখ ২৬ জুন।
একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ডিএসসিসির বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিস থেকে বিল পাঠালেও প্রধান কার্যালয়ে প্রশাসক, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রধান প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অফিস করতে না পারায় সেগুলোর অনুমোদন হয়নি। ফলে অনেক কাজের বিল নিষ্পত্তি ও চেক ইস্যু হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
ডিএসসিসির প্রশাসক শাহজাহান মিয়া মঙ্গলবার সন্ধ্যায় টেলিফোনে টিবিএসকে বলেন, 'সিটি কর্পোরেশনে এখন যেভাবে কাজ চলছে, সেটাকে বলা যেতে পারে আধাচলা অবস্থা। আমাদের রাজস্ব সংগ্রহ কমে গেছে। প্রকল্পের কাজ কিছু চলছে। তবে বিলগুলো দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বেশিরভাগ বিলই আটকে আছে। বিশেষকরে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রকল্পটির মেয়াদ এ মাসেই শেষ হবে। কিন্তু মেয়াদ বাড়ানোর আমরা এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। প্রকল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে শিশুদের টিকা কার্যক্রম ব্যাহত হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'উন্নয়ন প্রকল্পের কাজগুলো অধিকাংশই বন্ধ আছে। জরুরি কয়েকটি প্রকল্পের মাঠে কিছু কাজ হচ্ছে। আগামী অর্থবছর নিয়ে এ অচলাবস্থার মধ্যেই রাজস্ব বিভাগ বাজেট প্রণয়নের কাজ করছে।'
গত ১৮ মে ডিএসসিসির প্রশাসক শাহজাহান মিয়াকে সরকার ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়েছে। সেই থেকে তিনি কারওয়ানবাজারে ওয়াসা ভবনে নিয়মিত অফিস করছেন। ওই অফিসে তিনি ডিএসসিসির কিছু ফাইলও দেখেন।
সুত্র জানায়, শেষ সময়ে এসে অনেক কাজের বিস্তারিত যাচাই-বাছাই ছাড়াই ডিএসসিসির কর্মকর্তারা অনেকগুলো বিল অনুমোদন করেছেন। কারণ ওইসব প্রকল্পের মূল ফাইল নগর ভবনে আটকা পড়ায় কাজের পরম্পরা যথাযথভাবে যাচাই সম্ভব হয়নি।
পূরণ হবে না রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা
২২টি খাত থেকে রাজস্ব আয় হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের। সিটি কর্পোরেশনের আয়ের বড় উৎস হোল্ডিং ট্যাক্স, বিভিন্ন মার্কেটের ভাড়া, কমিউনিটি সেন্টারের ভাড়া, ইজারা এবং ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু ও নবায়ন। অর্থবছরের শেষ সময়ে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন থেকে আয় বেড়ে যায় অনেক।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ডিএসসিসি ১ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয় হয়েছিল ১ হাজার ৬১ কোটি টাকা।
এদিকে ডিএসসিসি থেকে চূড়ান্ত বিল দাখিল না করায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও তাদের কয়েকটি প্রকল্পের চুড়ান্ত বিল দাখিল করতে সমস্যায় পড়েছে।
অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, এ বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় জুন ক্লোজিংয়ের কার্যক্রম এলোমেলো হচ্ছে। জুনের শুরুতেই ছিল জাতীয় বাজেট। আর জাতীয় বাজেটের পরপরই কোরবানির ঈদ উপলক্ষে টানা ১০ দিনের ছুটির কারণে জুন মাসের অনেক কাজ সময়মতো করতে পারেনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থা।
এখন ওইসব সংস্থা কাজ শেষ না হলেও বিল দাখিল করছে, যাতে পরবর্তীতে ওই কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। অর্থ বিভাগকে জেনে-বুঝেই অসমাপ্তকে কাজকে সমাপ্ত হিসেবে গণ্য করে বিল অনুমোদন করতে হচ্ছে।